| সালমা আঞ্জুম লতা, অ্যারিজোনা থেকে |
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১। শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশ জাতীয় দলের একসময়কার দুর্দান্ত বাঁহাতি ওপেনার শাহরিয়ার নাফিস আহমেদের (আবীর) ক্রিকেট ক্যারিয়ার। আন্তর্জাতিক এবং ঘরোয়া সব ধরণের ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে নিল অবসর। জাতীয় দলে শাহরিয়ার নাফিসের জার্নিটা শুরু হয়ে ছিল ২০০৫ সালে। কিন্তু এই জার্নির বীজ বপন করা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। শাহরিয়ারের ক্রিকেট জার্নি পনের বছরের হলেও মা হিসেবে আমার জার্নি ছিল দীর্ঘ পঁচিশ বছরের।
বিভিন্ন সেনানিবাসে বড় হওয়া তিন বাচ্চাকে নিয়ে যখন প্রথম ঢাকা মোহাম্মদপুরের ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করি তখন ওরা বিকেলে খেলতে পারতো না, হাঁপিয়ে যেত। ১৯৯৫ সালে প্রথম ওদেরকে নিয়ে আবাহনী মাঠে যাওয়া শুরু করি। প্রথমে বিসিবির অধীনে, তারপর সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার ওয়াহিদুল গনির কাছে আমার দুই ছেলেই প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। আমি চেয়েছিলাম ওরা লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্য একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকুক।
নাফীসের বয়স যখন দুই আড়াই তখন থেকেই ফুটবল এর চাইতে ক্রিকেটের দিকে বেশি আগ্রহ ছিল। প্লাস্টিকের ছোট্ট ক্রিকেট ব্যাট আর পিংপং বল দিয়েই খেলতে পছন্দ করতো। খালাত ভাইদের বড় ব্যাট ধরার জন্য কান্নাকাটি করতো। সাড়ে তিন বছর বয়সে নাফীসকে প্রথম কাঠের ব্যাট কিনে দিয়েছিল আমার বড় বোন রত্না।
আমাদের পরিবারে ক্রিকেট খেলা ছিল খুবই জনপ্রিয়। নাফিসের মামারা ছাত্রাবস্থায় ক্রিকেট খেলতেন। খালাত ভাই ফারুক আহমেদ ছিল জাতীয় দলের খেলোয়াড়, অধিনায়ক এবং পরবর্তীতে প্রধান নির্বাচক। আমার অন্য ভাইগ্না ভাতিজারাও ক্রিকেট খেলতো। নাফিসের আড়াই বছর বয়সেই প্রথম লক্ষ্য করি ও বাঁ-হাতি।
আবাহনী মাঠ থেকেই পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র নাফিসের ক্রিকেট যাত্রা শুরু। রুটিন করে সপ্তাহে তিন দিন মাঠে নিয়ে যেতাম। সব মায়েরা যখন দুপুরের ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিতেন আমি তখন ওদেরকে মাঠে খেলতে দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম। প্রথম দিকে আমি ছাড়া অন্য কোন মায়েরা মাঠে আসতেন না।বছর দেড়েক পরে অন্য মায়েরাও আসতে শুরু করেন।
প্রশিক্ষণ চলার বছর দু-এক পরেই শুরু হয় বয়স ভিত্তিক নানা টুর্নামেন্ট।দেশের বাইরে ভারতের শিলিগুড়িতে প্রতিবছর অনূর্ধ্ব-১৩ একটা টুর্নামেন্ট হত। ১৯৯৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৩ দলের হয়ে নাফিসের আগেই আমার মেঝ ছেলে ইফতেখার নাঈম আদীব খেলতে গিয়েছিল শিলিগুড়ি। ২০০০ সালে বড় ছেলে শাহরিয়ার নাফিস প্রথমবারের মত অনূর্ধ্ব -১৫ খেলতে যায় মালয়েশিয়া। অনূর্ধ্ব- ১৫, অনূর্ধ্ব- ১৭, অনূর্ধ্ব -১৯ সবগুলো বয়সভিত্তিক খেলাই খেলেছিল।
খেলার জন্য লেখাপড়ায় যাতে ভাটা না পড়ে সেদিকে ছিল আমার তীক্ষ্ণ নজর। মাঠে নিয়ে যাবার আগেই ওদেরকে শর্ত দিয়ে রাখতাম। তাছাড়া সেন্ট যোসেফ স্কুল এবং নটরডেম কলেজে নির্দেশ দেয়াই ছিল পরীক্ষায় খারাপ করলেই টিসি।
প্রতিটা টুর্নামেন্ট, প্রতিটা ট্যুরে যাওয়ার আগে বেশ অনেকদিন থাকতে হত ক্যাম্পে। কমপক্ষে ১০/১৫ দিন। কখনো কখনো মাসব্যাপী। স্কুল কামাই হত। ক্যাম্পে, ট্যুরে বই দিয়ে দিতাম। তখনকার সেসব পড়া, বাড়ির কাজ ম্যানেজ করতে হত আমাকেই। কতবার আমাকে ওর স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের মুখোমুখি হতে হয়েছে আর অপরাধীর মত জবাবদিহি করতে হয়েছে তার হিসেব নেই।
আমার ছেলেরা লেখাপড়ায় মেধাবী ছিল। ক্লাস সেভেনে একই সাথে নাফিস সেন্ট যোসেফ স্কুল এবং মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ-এ (লিখিত পরীক্ষায়) চান্স পেয়েছিল। শুধুমাত্র ক্রিকেট খেলার জন্য ক্যাডেট কলেজে না দিয়ে সেন্ট যোসেফ স্কুলে ভর্তি করেছিলাম। আমি নাফিসকে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য জোর করতে পারতাম।
নিদেনপক্ষে বিবিএ এমবিএ পাস করে ভাল কোন জব করতে পারতো। কিন্তু আমি সেদিন ওর পছন্দকে মূল্য দিয়েছিলাম। নাফিসযে পথে হাঁটতে চেয়েছে সে পথের কাঁটাগুলো সরিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। ক্রিকেট এর প্রতি ওর ভালবাসা, ওর মেধা দেখে আমরাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করি কোন একদিন নাফিসের গায়ে উঠবে লাল সবুজের জার্সি। প্রতিনিধিত্ব করবে বাংলাদেশকে।
তৃতীয় বিভাগ থেকে শুরু করে প্রিমিয়ার লিগের খেলার জন্য ধূপখোলা মাঠ থেকে বিকেএসপি পর্যন্ত এমন কোন মাঠ নেই ওকে নিয়ে যাইনি। কত দিন দুপুরে না খেয়ে কাটিয়েছি।প্রতিটা জাতীয় বয়সভিত্তিক টিম সিলেক্ট হওয়ার আগে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি।
আম্মা, আমি টিমে চান্স পাবো তো?
ছেলের অসহায় চেহারা দেখে একেকসময় মনে মনে আমিই হয়ে যেতাম নির্বাচক।জায়গা করে দিতাম পেসার, স্পিনার, উইকেটরক্ষক সাথে স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানদের। ডানহাতি আর বাঁহাতি কম্বিনেশন এর কথা মাথায় রেখে নাফিসকে বাদ দেয়া হয়ে যেত অসম্ভব।পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতাম, তুমি দলে থাকবে। ইনশাআল্লাহ। আমার কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে ছেলে ঘুমিয়ে পড়তো।পরের দিন পেপারে ওর নাম দেখে পরম করুনাময় এর কাছে শুকরিয়া জানাতাম।
অনর্ধ্ব-১৯, যুবদলের পর ২০০৫ সালের ২১ জুন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল।ইংল্যান্ডের মাটিতেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৭৫ রান করে হয়েছিল ম্যাচ সেরা। একই বছর ১২ সেপ্টেম্বর সু্যোগ পেয়েছিল স্বপ্নের টেস্ট ক্রিকেট খেলার। ২০০৬ সালের অক্টোবরে ভারতে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দলের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পায়।
২০০৬ ছিল নাফীসের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সবচাইতে গৌরবোজ্জ্বল বছর। কারণ
- আইসিসির বর্ষসেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের জন্য মনোনীত হয়েছিল।
- ২০০৬ সালের বিসিবির সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়।
- ২০০৬ সালের বিসিবির সেরা ব্যাটসম্যানও নির্বাচিত হয়।
- নির্বাচিত হয় গ্রামীন ফোন ও প্রথম আলো বর্ষসেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব।
টেস্ট ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৩৮ রানের ইনিংসটা ছিল একটা মাইলফলক। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ওর চারটা সেঞ্চুরির কথা ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে রাখবে অনেকদিন। ২০০৬ সালে নাফীস প্রথম বাংলাদেশি যে এক ক্যালেন্ডার বছরে ১০০০ রান করার গৌরব অর্জন করেছিল।বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়কত্ব করার দায়িত্ব পেয়েছিল। টি-টোয়েন্টিতেও সেঞ্চুরি করার সৌভাগ্য হয়েছিল নাফিসের।
একদিনের আন্তর্জাতিক, টেস্ট ক্রিকেট, টি-টোয়েন্টি সহ নাফিস খেলেছে দু’দুটি বিশ্বকাপ । মা হিসেবে আমি চেয়েছিলাম যোগ্যতা অনুযায়ী খেলাধুলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ব্লু সম্মাননাটাও যেন পায়। সেটাও পেয়েছে।
বাংলাদেশকে হয়তো আরো অনেক কিছু দিতে পারতো, আরো অনেক কিছু দেয়ার যোগ্যতা ছিল। কিন্তু আমি আল্লাহর উপর বিশ্বাস করি। ওর ভাগ্যে এতটুকুই ছিল। লেখাপড়া, ক্রিকেটের পাশাপাশি একজন ভাল মানুষ বানাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সততা, আন্তরিকতা এবং কৃতজ্ঞতাবোধ এর কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি আমার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছি। জানি না কতটুকু সফল হয়েছি।
যে কোন বিদায়ই হৃদয় বিদারক। তবু মেনে নিতে হয়। জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার অনেক পরে আমরা উপলব্ধি করি কোথাও ভুল ছিল কি না। আমি মা হিসেবে এই দু’আ করি এবং আশা করবো এরপর নাফীস যে কাজটাই করবে যেন সততার সাথে করে, আন্তরিকতার সাথে করে। দেশের অসংখ্য মানুষের, অগণিত ভক্তদের যে অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছে তার মর্যাদা যেন রাখতে পারে।
সবশেষে বলবো, শাহরিয়ারের মা হিসেবে আমিও পেয়েছি অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালবাসা। আমি সকলকে জানাই অন্তহীন কৃতজ্ঞতা। অনেকেই আমাকে বলে আমি ‘রত্নগর্ভা’। আমি রত্নগর্ভা কি না জানিনা তবে আমি অতি সাধারণ একটা ঝিনুক যার গর্ভে তিনটি অসাধারণ মুক্তোর জন্ম হয়েছিল। আমার সেই মুক্তোরা সব মানুষের প্রগাঢ় ভালবাসায় বেঁচে থাকুক।