সাকিব আল হাসান ক্রিকেটের লড়াইয়ে নেই, তিনি লাল-সবুজের জার্সিতেও নেই। তবে তিনি আলোচনায় আছেন। মাঠে সাকিবকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও তিনি খবরে থাকেন। এইতো সর্বশেষ নিজের ভেরিফাইড পেজে একটি প্রোমোশনাল পোস্ট দিয়ে আড্ডার টেবিলের হট কেক বনে গেলেন বাংলাদেশের পোস্টার বয়।
গত ২ আগস্ট সাকিব আল হাসান তাঁর ফেসবুক পেজে জানান নতুন এক সম্পর্কের কথা। বেটউইনার নিউজ নামের একটি ক্রিকেটীয় সাইটের সাথে অফিশিয়াল পার্টনার হওয়ার খবর পোস্ট করেন তিনি। আর এরপরই নড়চড়ে বসেছে বাংলাদেশের দর্শক-সমর্থকেরা। কারন আদতে নিউজ পোর্টাল মনে হলেও ‘বেটউইনার নিউজ’ মূলত একটি বেটিং সাইট।
১৮৬৭ সালে প্রণীত পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ। সাধারণ আইন তো বটেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) বেটিং সংশ্লিষ্ট কারো সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী নয়। তাই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ফ্রাঞ্চাইজি মালিকানার দরপত্রে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে বেটিং সাইটের কেউ আবেদন করতে পারবে না। অথচ বিসিবির অধীনের একজন খেলোয়াড় হয়েও সাকিব আল হাসান এখন বেটিং সাইটের সাথে সংশ্লিষ্ট।
নামটা বেটউইনার নিউজ; ক্রিকেটের নিউজ হাইলাইটস ইত্যাদি দেখা যায় তাদের সাইটে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির আয়ের মূল উৎস অনলাইন বেটিং। প্রতিদিন হাজারের বেশি লাইভ ইভেন্ট চলে তাদের সাইটে। অবশ্য বাংলাদেশ থেকে সরাসরি এই ওয়েবসাইটে ঢোকাই বারণ; বুঝতেই পারছেন আইনে নিষিদ্ধ।
কিন্তু এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে সাকিব আল হাসান কি বুঝে চুক্তিবদ্ধ হলেন? তিনি কি বাংলাদেশের আইন কিংবা বিসিবির নীতিমালা সম্পর্কে জানেন না?
সাকিব আল হাসান সবই জানেন, তিনি বোঝেনও। তারপরও সাকিব বেটউইনার সাইটের একজন ব্র্যান্ড আম্বাসেডর হতে সম্মত হয়েছেন। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের জীবনে অবশ্য বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এবারই প্রথম নয়। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে নিজের খেয়ালখুশি মত চলা সাকিবের জন্য নিষেধাজ্ঞা, জরিমানা এসব ছিল নিয়মিত সঙ্গী।
পরিনত হওয়ার সাথে সাথে বিশৃঙ্খল, হেঁয়ালি জীবন যাপনের পরিমাণ অবশ্য কমে এসেছে; দায়িত্ব নিতে শিখেছেন তিনি। তবুও ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলা – না খেলা, বারবার ছুটি নেয়া এসব ইস্যুতে প্রায়শই আলোচনা-সমালোচনায় উঠে আসেন সাকিব।
২০১৯ সালে স্বপ্নীল এক বিশ্বকাপ খেলার পরেই সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছিল। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) কাছ থেকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন তিনি। এতদিনে নিশ্চয়ই জানা হয়ে গিয়েছে সেটিও ছিল এমন জুয়া আর ফিক্সিং সম্পর্কিত কাণ্ডে।
যদিও শাস্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু সেবার সাকিব ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়াননিও। এখনও তিনি হয়তো বেটিং সাইটে ভাগ্য পরীক্ষা করবেন না। কিন্তু যেভাবে দেশের নানান বয়সের ক্রিকেট ভক্তদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলেন একটি বেটিং সাইটের; তাতে সাকিবের বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
বলিউডের অক্ষয় কুমারের ঘটনাটা জানে না এমন মানুষ কমই। সাকিব নিজে সেটা জানেন কি? অক্ষয় কুমার অধূমপায়ীদের হয়ে ক্যাম্পেইন করেছিলেন কিন্তু বিমল পান মাসালার বিজ্ঞাপন করার দায় এড়াতে পারেননি, তাঁকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল সবার কাছে।
সাকিব আল হাসানকে হয়তো ক্ষমা চাইতে হবে না। এমনকি কোনরূপ শাস্তিও হয়তো তিনি পাবেন না। বিশ্বে এখন বেটিং সাইট ওপেন সিক্রেট। আইসিসির এসব নিয়ে খুব একটা পদক্ষেপ নেই।
তাছাড়া আইসিসি কিংবা বিসিবি চাইলেও কিছু করতে পারার কথা না। কারন, সাইটটি একধরনের নিউজ পোর্টাল। এখানে ক্রিকেটের খবর, ম্যাচ হাইলাইটস আর অ্যানালাইসিস আছে। সে হিসেবে এমন বিজ্ঞাপন করায় বাঁধা থাকার কথা না। সাকিবের পরামর্শকরাও হয়তো একই যুক্তি দেখিয়েছে।
কিন্তু দিন শেষে একটা কথা বলাই যায়, এমনটা না করলেও পারতেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের আইনে নিষিদ্ধ কাজ যে-ই করুক, অন্তত দেশের সবচেয়ে বড় সুপারস্টারের কাছ থেকে আশা করা যায় না।
বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একজন সাকিব আল হাসান। সংস্কৃতি শেখার এই প্রক্রিয়ায় তাকেই শিক্ষকের ভূমিকায় দেখছে উদীয়মান ক্রিকেটাররা। শুধু ক্রিকেটার নয়, দেশের তরুণ বড় একটা অংশ সাকিবকে অনুসরণ করে। একজন আইডলের চেয়ারে বসে আইনের মারপ্যাঁচ গলে একটা কাজ করাই যায়, কিন্তু নৈতিকতা প্রশ্নে থমকে দাঁড়াতেই হবে।
যখন খবরের শিরোনাম হবে জুয়া খেলতে গিয়ে সর্বস্ব হারানো কারো ঘটনা, যখন শিরোনাম হবে জুয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে সহিংসতা; তখন ঠিকই বিবেকের কাঠগড়ায় উঠবে সাকিব আল হাসানের এই পোস্ট, এই সিদ্ধান্ত।