সাকিব একটাই, তাঁকে চেনা বড় দায়

আদতে সাকিব আল হাসান বরাবরই আনপ্রেডিক্টেবল হলেও একটা জায়গায় তিনি সবসময় প্রেডিক্টেবল। সেটা পারফরম্যান্সে। অন্তত ব্যাটে নয়তো বলে, সাকিব ঠিকই পারফর্ম করে যাবেন। গেল প্রায় ১৮ বছর ধরে এমনটাই দেখে আসছে সবাই। কিন্তু সম্প্রতি তার ব্যত্যয় ঘটে।

আদতে সাকিব আল হাসান বরাবরই আনপ্রেডিক্টেবল হলেও একটা জায়গায় তিনি সবসময় প্রেডিক্টেবল। সেটা পারফরম্যান্সে। অন্তত ব্যাটে নয়তো বলে, সাকিব ঠিকই পারফর্ম করে যাবেন। গেল প্রায় ১৮ বছর ধরে এমনটাই দেখে আসছে সবাই। কিন্তু সম্প্রতি তার ব্যত্যয় ঘটে।

যে কারণে টানা ব্যাটে-বলে নিষ্প্রভ পারফরম্যান্সে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের পর অনেকে সাকিবের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের এপিটাফ লিখে ফেলেন। তাঁর শেষ দেখে ফেলেন বাংলাদেশি সমর্থকদের একটা বড়ো অংশ। ওদিকে বীরেন্দর শেবাগ তো বলেই বসেন, লজ্জা পাওয়ার পাশাপাশি সাকিবের অবসরে যাওয়া উচিত। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী ম্যাচেই গতকাল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পাওয়া দলের গুরুত্বপূর্ণ জয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সাকিব।

কে কী বলেছিল, সেসব রেখে নিজের কথায় আসি। ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনও পর্যন্ত সাকিবের ক্যারিয়ারের শেষ দেখার দু:সাহসটা করতে পারিনি। কারণটা তাঁর ক্যালিবার। আর সে ক্যালিবারটা হলো, বরাবরই সমালোচনার মুখে একদম আলো কেড়ে নেওয়া পারফরম্যান্সের মাধ্যমে সকলের মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়া।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচের দিন সকালে আমার টাইমলাইনে একটা লেখা লিখেছিলাম। তুমুল বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া সাকিবকে নিয়ে সে লেখায় তাঁর কাছে আমার চাওয়াটা উল্লেখ করেছিলাম। খুব বেশি কিছু না, শুধু চেয়েছিলাম অন্তত বল হাতে যেন এই নেদারল্যান্ডস ম্যাচটা দিয়েই ছন্দে ফিরতে শুরু করেন তিনি। কারণ, বোলিংটা বরাবরই সাকিবের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা।

অথচ তিনি কী করলেন! ছন্দ ফিরে পাবার লড়াইয়ের শুরুটা করলেন ব্যাট হাতে, যেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি। গতকাল ম্যাচের আগে কেউ যদি এসে আমাকে বলত যে, সাকিব ব্যাট হাতে অর্ধশতক হাঁকাবেন কিংবা ম্যাচ জয়ের পেছনে কার্যকরী ইনিংস খেলবেন, আমি সে কথা এক হাসিতেই ওড়িয়ে দিতাম। এর পেছনে কারণ হলো সাকিবের চোখের সমস্যাটা। মূলত ওই সমস্যার কারণে ভালো ব্যাটিং করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে তাঁর জন্য।

লেখাটার শেষদিকে আমি একটা লাইন লিখেছিলাম। লাইনটা ছিল এ-রকম, ‘Even with obstacles, he has always managed to perform somehow.’ ঠিক যেন এ কথাটাই আরেকটিবারের মতো অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।

সাকিবের এমন আনপ্রেডিক্টিবিলিটির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ বোধ হয় ২০১৭ সালের কলম্বো টেস্টে শতক হাঁকানো ইনিংসটা। বাংলাদেশের শততম সেই টেস্টে দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ হওয়ার ৩.১ ওভার বাকি থাকতে উইকেটে নামেন সাকিব। চায়নাম্যান সান্দাকানের বলে টানা দুই উইকেট হারিয়ে খানিক বিপাকে তখন বাংলাদেশ৷ এমন সময় হ্যাটট্রিক বলটা খেলতে নেমেই চার হাঁকান সাকিব। পরের ওভারে তিনি স্ট্রাইক পাননি। ওই ওভারে আরও একটা উইকেট খোয়ায় বাংলাদেশ।

দিনের খেলা শেষ হতে বাকি আর মাত্র ২ ওভার। এমতাবস্থায় ছন্দে থাকা সান্দাকানের পুরো ওভারটা সাকিব চার্জ করে খেলেন। অপ্রয়োজনীয় শট খেলতে গিয়ে একবার তো ক্যাচও তুলে দেন। কিন্তু থারাঙ্গা ক্যাচ মিস করায় সে যাত্রায় বেঁচে যান সাকিব। তারপর শেষ ওভারে দুইটা বল মোকাবেলা করেন তিনি। ওখানে প্রথম বলেই আরেকটি এলোমেলো শটে ক্যাচ ওঠালেও তাতে নাগাল পায়নি ফিল্ডার। ফলে আবারও বেঁচে যান তিনি।

ওইদিন উইকেটে নামার পর থেকে আক্ষরিক অর্থে প্রতি বলেই শট খেলতে উদ্ধত হন সাকিব। তাঁর এই অ্যাপ্রোচ দেখে সবাই রীতিমতো থ হয়ে যায়। দিনশেষে ৮ বলে ১৮ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি।

অথচ সেই সাকিবই পরের দিন যেন পুরোপুরি ভোল পালটে ফেলেন। সেদিন তিনি কতটা স্মার্ট ও সাবলীল ব্যাটিং করেছিলেন, তা না দেখে থাকলে লিখে বুঝানো যাবে না। একবারের জন্যও মেজাজ না হারিয়ে প্রতিপক্ষের বোলারদের পর্যাপ্ত সমীহ করে একদম ধীরস্থিরভাবে টেস্ট মেজাজে খেলে ১৪৩ বলে শতক তুলে নেন তিনি।

এমনিতে সে সময়টায় টেস্টে আগ্রাসনের সাথে ব্যাটিং করতে গিয়ে উইকেট উপহার দেওয়ায় নানা সমালোচনায় বিদ্ধ ছিলেন সাকিব। ওই শ্রীলঙ্কা সফরের আগে হায়দরাবাদে ভারতের বিপক্ষে ওয়ান-অফ টেস্টে মুশফিকের সাথে ১০৭ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়ার পর ব্যক্তিগত ৮২ রানে মেরে খেলতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে দেওয়ায় কম কথা শুনতে হয়নি তাঁকে।

পরবর্তীতে কলম্বো টেস্টের দ্বিতীয় দিনের শেষ পনেরো মিনিটে বেপরোয়া ব্যাটিংয়ের পর তো স্বাভাবিকভাবেই সমালোচনাটা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু পরদিন স্কুলের সবচেয়ে শান্ত ছেলেটার মতোই শতক হাঁকানো ও-রকম একটা ইনিংস যে খেলে বসবেন সাকিব, সেটা নিশ্চিতভাবে কেউই প্রত্যাশা করেনি। আসলে এটাই সাকিব আল হাসান, যাঁকে চেনা সত্যিই বড় দায়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...