ভুল!

ভুল আছে বলেই স্পোর্টস সুন্দর, স্পোর্টস সুন্দর বলেই ভক্তকুল এর পূজারী, ভক্তকুল আছে বলেই ভুলগুলো সঠিক হবার দিশা পায়! ভক্তকুলের নিবেদন একজন স্পোর্টসম্যান থেকে কোন অংশেই কম হওয়া উচিত নয়।

২০১৯ সালের বিশ্বকাপ স্মৃতিতে দগদগে ঘাঁ হয়ে আছে মুশফিকুর রহিমের সেই ছেলে মানুষী রান আউট মিস করার অংশটা। মুশফিককে অপরাধী বানিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ট্রল, বারবার তাকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যাতনার স্মৃতি! ওই মিসটা না হলে হয়ত বিশ্বকাপের গল্পটা ভিন্ন হতে পারত, অন্তত এদেশের ক্রিকেট ভক্তদের ধারনা তেমনই!

সম্ভাবনাটা হয়ত মিথ্যা নয়, হয়ত সেই রান আউটটা এদেশের ক্রিকেটকে দিতে পারত নতুন পথের সন্ধান। হয়ত এনে দিতে পারত সোনালী ট্রফিটাও! বেশি বলে ফেললাম? বেশি হতে যাবে কেন! সম্ভবনা নিয়েই যদি আমাদের এত চর্চা, তাহলে বিশ্বকাপ ট্রফির সম্ভবনা নিয়ে বলাটা কি বাড়াবাড়ি? যেভাবে এক বছর পেছনের স্মৃতিকে সামনে এনে মুশফিকুর রহিমকে পুনরায় ট্রল করার উপলক্ষ খুঁজে বের করছি আমরা, তাতে করে বিশ্বকাপটাই মিস করে গেছি টাইপ উপলব্ধি হওয়া কি আমার জন্য অন্যায় হবে!

মুশির রান আউট মিসটা বড্ড বেশি রকমের দৃষ্টিকটু, হ্যাঁ মেনে নিচ্ছি। সেই সাথে এটাও জানিয়ে দিচ্ছি মুশিই প্রথম নয় যার চাইল্ডিশ ভুলে বিশ্বকাপের গল্প ভিন্ন হয়েছে কোন দলের! চার বছর পরপর আগত ওই সোনালী ট্রফিটার লড়াইয়ে অনেকেই এমন কিছু ভুল করেছে যা কিনা কাঁটা হয়ে পথ রোধ করেছে সেই দলের!

মনে আছে সেই ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ?

গ্রুপ পর্বের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার করা ২৭১ রানের জবাবে যখন অস্ট্রেলিয়া কাদাজলে আটকে গিয়েছিল, তখন স্টিভ ওয়াহ নামক এক অজি ভদ্রলোকের আপ্রান চেস্টায় কাদা থেকে জয়ের গাড়ীটা বের হয়ে আসে! কিন্তু অজি অধিনায়কের সেই ইনিংসের নেপথ্য কাহিনী কিন্তু বিখ্যাত!

স্টিভের প্রদত্ত এক ডলি ক্যাচ হাত থেকে ফেলে দেন তৎকালীন সময়ের অন্যতম সেরা ফিল্ডার হার্শেল গিবস! ম্যাচ হারে সাউথ আফ্রিকা, সেই সাথে হয়ত বিশ্বকাপটাও সেবারের মত মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের থেকে! প্রশ্ন করতে পারেন, গ্রুপ পর্বের হারা ম্যাচ কিভাবে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেয় কোন দলকে? কারনটা হয়ত প্রত্যক্ষ নয়, তবে পরোক্ষ তো বটেই! সেমিফাইনালে যে এই অজিদের সাথেই টাই হয় দক্ষিণ আফ্রিকার এবং গ্রুপ পর্বের ম্যাচে হেড টু হেড জয়ের ভেলায় চেপে অজিরাই ফাইনালগামী হয়! গিবসের মিসটাকে ট্রল করি চলুন!

আচ্ছা, গিবসেরটাকে রেহাই দিয়ে চলুন ক্লুজনারের মুণ্ডপাত করি। ওই পাগলাটে দৌড় না দিলে তো সেমিফাইনালটা টাই হয় না! হাতে অতগুলো বল থাকা স্বত্বেও ব্যাটা কিনা ভুতুড়ে দৌড় দিয়ে বসল! অথচ, ওই বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার কিন্তু ক্লুজনার! ভুলটা না করলেই কিন্তু ফাইনালের মঞ্চ সাজানো ছিল প্রোটিয়াদের জন্য, কে জানে হয়ত সোনালী ট্রফিটাও!
চলুন ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়ারটার পেজে গিয়ে তাকে স্মরণ করিয়ে দেই! বলে আসি, ব্যাটা চোকার্স কোথাকার!

অথবা চলুন মিসবাহ উল হককে একহাত নিয়ে নেই! ব্যাটা উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে শেষে কিনা তীরের কাছে এসে সাগরে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করল! কি দরকার ছিল যোগিন্দর শর্মার মত এলোমেলো বোলারের বলে অমন স্কুপ করতে যাবার? অনায়াসে বাকি বলগুলো থেকে একটি বাউন্ডারি তো বের হতই! ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপে একটিও জয়ের মুখ না দেখা পাকিস্তান পেতে পারত সোনালী আভায় রাঙানো এক জয়!

মিসবাহ হিট অফ দ্য মোমেন্টে ভুল করে গেলেন, অপরদিকে তার এই ভুল বের করে আনলো ভারতের অন্যতম সফল এক অধিনায়ককে! কে জানে, সেই বিশ্বকাপটা না জিতলে ধোনির ক্যারিয়ারের পথ কোনমুখী হত! আসুন, মিসবাহকে মনের আশ মিটিয়ে গালি দেই!

২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে নুয়ান কুলাসেকারা যখন গম্ভীরের ক্যাচ ফেললেন তখন ভারত কিন্তু বোতলে বন্দি জ্বীনের মত হাঁসফাঁস করছে! গম্ভীর এরপর তেলতেলে একটি ইনিংস খেলে ফেললেন, বোতলের মরিচা ধরা ছিপি গেল খুলে, ভারতের ৩০ বছরের বিশ্বকাপ খরায় বৃস্টি নামলো! কুলাসেকারার ফাঁসি চেয়ে আন্দোলন করি চলুন!

২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যখন ৭ বলে ১৪ রান দরকার নিউজিল্যান্ডের, তখনই গ্রান্ড এলিয়টের ক্যাচটা তালুবন্দি করতে ব্যর্থ হন ডুমিনি এবং বেহারদিন! গ্রান্ড এলিয়টের ক্যাচ! হ্যাঁ, নিউজিল্যান্ডকে একা হাতেই ম্যাচ জিতিয়ে ফেরা গ্রান্ড এলিয়টের ক্যাচ!

অথবা তারও আগে বল গ্লাভসে না নিয়েই স্ট্যাম্প ভেঙে ফেলা ডি কক যখন এলিয়টকে প্রথমবারের মত জীবন দেন! পুরো ম্যাচেই এমন অসংখ্য ভুল, দিনশেষে চোকার্স খেতাব! চলুন, পুরো সাউথ আফ্রিকা টিমকেই আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাসনে পাঠাই!

এমন অসংখ্য ঘটনা আছে বিশ্বকাপে তথা ক্রিকেটে! ডিসিশনের ভুল, হিট অফ দ্য মোমেন্টের ভুল, অগনিত! দিনশেষে এগুলোর প্রত্যেকটিই অনিচ্ছাকৃত! এগুলো আফসোসের কারন হতে পারে অবশ্যই, কিন্তু ট্রলের আধার নয় কোনভাবেই! আক্ষেপ থাকতেই পারে, যাতনায় পুড়তেই পারে ভক্তকুল, কিন্তু সেই সাথে এটাও উপলব্ধি করতে হবে যে, ঠিক সমপরিমাণ বা তার থেকেও বেশি অনুশোচনার আগুনে পোড়ে ওই ভুল করা ব্যক্তিটি।

ভক্তকুল যদি আক্ষেপ বা আফসোসের মশালে আগুন লাগিয়ে ভুলকারীর মনের গৃহে আগুন দিয়ে শান্তি পায়, তাহলে সেই ভক্তকুলকে আর যাই হোক শুদ্ধ স্পোর্টসপ্রেমী বলা যায় না। আফসোস বা আক্ষেপের ছাইচাপা আগুনে উৎসাহের জল ঢেলে যে ভক্ত ভুলকারীর ভুলকে ক্ষমা করে, সেই ভক্তই একদিন তার মহত্বের পুরস্কার পায়! ভুল আছে বলেই স্পোর্টস সুন্দর, স্পোর্টস সুন্দর বলেই ভক্তকুল এর পূজারী, ভক্তকুল আছে বলেই ভুলগুলো সঠিক হবার দিশা পায়! ভক্তকুলের নিবেদন একজন স্পোর্টসম্যান থেকে কোন অংশেই কম হওয়া উচিত নয়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...