আবেগের পায়ে কুড়াল মারবেন না!

সেই তাঁরাই তো আবার যত বাজেই খেলুক না কেন, সবকিছু ভুলে পুনরায় টিভি সেটের সামনে এবং গ্যালারিতে বসে পড়েন নিজেদের দলটাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জোগাতে। এই বিষয়টাও ক্রিকেটারদের মাথায় রাখা উচিত। আর দর্শকদের এমন সমর্থনের জন্যই কিন্তু এ দেশে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের জীবন এতটা চাকচিক্যপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচটা হারার পর অনেককেই বলতে দেখছি, তাঁরা আর কোনোদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা দেখবেন না। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। রাগ-ক্ষোভ ও অভিমানে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু, তার পরেও আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের খেলা আর দেখব না বলা লোকেদের সিংহভাগই তৃতীয় ম্যাচটা ঠিকই সময়মতো দেখতে বসে যাবেন। এমনকি সে ম্যাচ জিতলেও যে বিশেষ কোনো লাভ হবে না, তা জানা সত্ত্বেও।

এখন প্রশ্ন হলো, এর পেছনে কারণটা কী? বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটীয় সামর্থ্য? যে সামর্থ্যের জোরে দর্শকদের খেলা দেখতে বাধ্য করেন তাঁরা? হাহা! মোটেও না। সেই সামর্থ্য থাকলে কী আর যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচ হেরে সিরিজ খোয়ায় বাংলাদেশ! তাহলে আসল কারণটা কী?

সেটা ব্যক্তিভেদে স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন হবে। তবে এতটুকু নিশ্চিত, কারণটা আমাদের ক্রিকেট দলের সক্ষমতা বা দক্ষতা নয়।

নিজের কথাই বলি। না, এমনটা কোনোসময়ই আমার ভাবনায় আসেনি যে, বাংলাদেশের খেলা আর কখনোই দেখব না। বাংলাদেশ যত খারাপই খেলুক; যতই হংকং, জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান (বর্তমান দল নয়), আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ কিংবা সিরিজ হারুক; এমনটা আমি কোনোদিনও ভাবিনি।

তবে, এটাও সত্য যে, শুধু দেশটা জড়িত বলে, নইলে কবেই আমাদের ক্রিকেট দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতাম আমি। শুধু নিজের দেশ বলে দলটার প্রতি আলাদা একটা টান কাজ করে, নয়তো এ দলের খেলা দেখার জন্য রাত জাগা, রোদে পুড়ে নয়তো বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে মাঠে ‘অখাদ্য’ খেয়ে দিন পার করা কিংবা গাঁটের পয়সা খরচ করে দেশের বাইরে যাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না!

আমি নিশ্চিত, এমনটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই না, আরও লক্ষ-কোটি মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আসলে আমাদের ক্রিকেটাররা কী মনে করেন? তাঁদেরকে ঘিরে গোটা জাতির এই যে উন্মাদনা, সেটা কি তাঁদের মাঠের খেলা দেখে? একদমই না। আমি অন্তত তা বিশ্বাস করি না।

ভাই, বাংলাদেশের মানুষ শুধু নিজ দলেরই খেলা দেখে না। এ জাতি বিশ্বনন্দিত দেশগুলোর খেলা থেকে শুরু করে জগতের এমন কোনো ফ্র্যাঞ্জাইজি লিগ নেই যা অনুসরণ করে না। তাহলে যাঁরা অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের মতো দলগুলোর খেলা নিয়মিত দেখে থাকেন, তাঁরা কোন দু:খে বাংলাদেশের মতো একটা আন্ডারপারফর্মিং দলের জন্য যুগের পর যুগ এ-রকম পাগলামি করবে!

আমি নিয়মিতভাবে ক্রিকেট খেলা দেখছি দুই দশক হতে চলল। এখানে ক্রিকেট খেলা দেখা মানে কিন্তু শুধু বাংলাদেশের খেলা দেখা না, অন্যান্য দলগুলোর খেলাও নিয়মিত অনুসরণ করা। এর মধ্যে আবার নানা সীমাবদ্ধতার বাস্তবতায়ও এক যুগের বেশি সময় ধরে মাঠে বসে খেলা দেখে আসছি। শুধু ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি নয়, গোটা টেস্ট ম্যাচও দেখে ফেলেছি অনেকগুলা। আর এই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মাঠে বসে আমার দেখা সবগুলো ম্যাচেই একটা দল ছিল কমন। সেটা বাংলাদেশ।

কিন্তু এটা কি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্স স্ট্যান্ডার্ডের কারণে? উঁহুঁ। ওই যে বললাম না, নিজের দেশ বলে কেমন যেন একটা আলাদা টান অনুভব হয়, শুধু ওই টানের জোরেই বাংলাদেশের মতো আন্ডারপারফরর্মিং, মেজর কোনো শিরোপা না জেতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে গড়পড়তারও নিচের একটা দলের জন্য যুগের পর যুগ আমার সমর্থন জুগিয়ে যাওয়া।

নয়তো যেই আমি রিকি পন্টিংয়ের অদম্য অস্ট্রেলিয়াকে ক্রিকেটবিশ্ব শাসন করতে দেখেছি, ভারতের মতো একসময়ের একটা গড়পড়তা দলকে দেখেছি কীভাবে সময়ের সাথে সাথে নিজেদের ভেঙেচুরে গড়ে তুলে প্রথমে ঘরে এবং পরে ঘরের বাইরেও তিন সংস্করণেই দাপিয়ে বেড়াতে এবং বর্তমানে প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়াকে দেখছি পুনরায় ক্রিকেটবিশ্ব শাসনের ঐতিহ্যটা ফিরিয়ে আনার পথে; সেই আমি কেন বাংলাদেশের মতো একটা দলের জন্য যুগ যুগ ধরে সময়, শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করতে যাব!

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা তাঁদের ভক্ত-সমর্থকদের গ্রান্টেড হিসেবেই ধরে নিয়েছেন। যে কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মূল স্টেক হোল্ডারের প্রতি তাঁরা কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না। হ্যাঁ, দায় দর্শকদেরও রয়েছে৷ তাঁরা অনেকসময় ক্রিকেটারদের ব্যাপারে সীমা অতিক্রম করে বাড়াবাড়ি করে ফেলেন।

কিন্তু সেই তাঁরাই তো আবার যত বাজেই খেলুক না কেন, সবকিছু ভুলে পুনরায় টিভি সেটের সামনে এবং গ্যালারিতে বসে পড়েন নিজেদের দলটাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জোগাতে। এই বিষয়টাও ক্রিকেটারদের মাথায় রাখা উচিত। আর দর্শকদের এমন সমর্থনের জন্যই কিন্তু এ দেশে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের জীবন এতটা চাকচিক্যপূর্ণ।

আমি বোধ হয় ইমোশনালি আউটব্রাস্ট করে ফেললাম। সেটাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই প্রথম বারের মতো। আমার মনে হচ্ছে, এটা করাটা সময়ের দাবি। সে দাবিটা আরো আগেই ছিল, কিন্তু করিনি।

তবে, যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ পরাজয়ে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলাম না। যে দলটার প্রতি এত টান, এত অনুভূতি, এত বিনিয়োগ- সেসব কারণে বোধ হয় এই অম্লতিক্ত কথাগুলো লিখার পরেও একটা ক্ষমা আমি নির্দ্বিধায় পেয়ে যেতেই পারি।

ক্ষমা করবেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রিয় ক্রিকেটারবৃন্দ!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...