বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান কে? নিশ্চয়ই লিটন দাস। আর তার পরে যদি অন্যদের কথা বলতে হয়, তাহলে শুরুর দিকেই আসবে নাজমুল হোসেন শান্তের নাম। অবশ্য ব্যাট হাতে ফর্মের সবচেয়ে তলানিতে থাকা ২৪ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের নামের পাশে ‘প্রতিভাবান’ শব্দটা লেখাটা প্রহসনই বটে।
তবে, মানুন আর নাই মানুন – এটাই সত্যি। এর পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও আছে। বয়সভিত্তিক দল থেকেই বিসিবির রাডারে ছিলেন নাজমুল শান্ত। পারফর্মও করেছেন সমানতালে। অনূর্ধ্ব ১৯ পর্যায় শেষ করেছিলেন একেবারে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েই। হ্যাঁ, বাবর আজম কিংবা বিরাট কোহলিদের মতই সম্ভাবনা ও প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত।
বিসিবি তাই তাঁর পেছনে বিনিয়োগের কমতি রাখেনি। টপ অর্ডারে আস্থার প্রতিদান দিতে পারবেন এই বাঁ-হাতি ব্যাটার – ভাবনাটা ছিল এমনই। বিসিবি এর আগে পরে আর কোন ক্রিকেটারকে নিয়ে এমন উঠেপড়ে লেগেছিল সেটা বলা মুশকিল। শান্তর মত যত্ন ও সুযোগ সম্ভবত এর আগে আর কোনো বাংলাদেশি ক্রিকেটারই পাননি।
‘এ’ দলের সফরগুলোতে নিয়মিত পাঠানো হয়েছিল শান্তকে। তাকে ভাবা হয়েছিল ভবিষ্যৎ অধিনায়কও। তাই ‘এ’ দল বা হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের অধিনায়ক হতেন প্রায়ই। এমনকি বিসিবির আয়োজিত ঘরোয়া লিগ গুলোতেও অধিনায়কত্ব পেতেন। অথচ, যুব পর্যায়েও তিনি অধিনায়কত্ব করেননি কখনো।
২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল স্রেফ দলের অন্দরমহলটা বোঝাতে। এই সুযোগটাও আগে পরে কেউ পাননি। সেবার দলে এক গাদা ইনজুরির জের ধরে সুযোগ এসেছিল টেস্ট অভিষেকের। সেটা দৈবক্রমে পাওয়া সুযোগ। আদতে সেই সিরিজে স্রেফ দলের সাথে থেকে ভবিষ্যতের জন্য গড়তে সাথে নেওয়া হয়েছিল শান্তকে।
আচমকা সেই টেস্ট অভিষেকে দুই ইনিংস মিলিয়ে রান করেছিলেন মোটে ৩০। উইকেটে কাটিয়ে দিয়েছিলেন ১১৬ বল। তখন ছিল দলের ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময়। একের পর এক উইকেট পতন হচ্ছে। ক্ষুদে শান্ত নিজের মত করে তখনই লড়াই চালিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে তাঁর টেস্ট টেম্পারমেন্ট দলকে ও টিম ম্যানেজমেন্টকে এক ইতিবাচক বার্তা দেয়।
ফলে, শান্তকে নিয়ে আশা বাড়তে থাকে। টপ অর্ডারে বিশেষ করে তিন নম্বরের জন্য তাঁকে ভাবা হয়। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপটাই আসলে শান্তর আত্মবিশ্বাসটা নাড়িয়ে দেয়। ওপেনার হয়ে তিনি একদমই রানের দেখা পাননি। সমস্যাটা এতটাই মারাত্মক ছিল যে ফাইনাল ম্যাচে লিটন দাসের সাথে ওপেনার হয়ে নামানো হয় মেহেদী হাসান মিরাজকে।
শান্ত তবুও হারিয়ে যাননি। বিসিবিও তাঁর বিনিয়োগ বন্ধ করেনি। শান্ত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ঝড়ো শতক করেন। এশিয়ান গেমসে অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশকে স্বর্ণপদক জিতিয়ে আনেন।
এরপর আবার কালক্রমে তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ফেরেন। পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট খেলতে গিয়ে দারুণ এক হাফ সেঞ্চুরি করেন। তখন বলেছিলেন, দলে জায়গা হারানোর ভয়টা আর তিনি পাননা, ‘সত্যি কথা বলতে, এর আগে যখন খেলেছি, তখন একটা ভয় কাজ করতো। মনে হতো যে, খারাপ খেললে বাদ পড়তে পারি, বা এমন কিছু একটা ছিল। মানে, আগে যখন ২০১৭ সালে অভিষেক হয়েছে, তখন এই ব্যাপারটা ছিল। তবে এখন আমি মানসিকভাবে তেমন কিছু চিন্তা করছি না। ভালো খেলি কিংবা খারাপ খেলি, সেটা আসলে আমার দিক। দলে থাকব কি থাকব না, সেটা নিয়ে ভাবছি না।’
তবে, হ্যাঁ! এখন সত্যিই ভয় পাওয়ার সময় এসেছে শান্তর। ১৮ টেস্টের ক্যারিয়ারে ব্যাটিং গড় যে মোটে ২৫-এর মত। দু’টো সেঞ্চুরির ইনিংস বাদ দিলে আর কিছুই নেই ক্যারিয়ারে। এর বাইরে বলার মত ইনিংস কেবল দু’টি হাফ সেঞ্চুরি। ধারাবাহিকতার বালাই নেই বললেই চলে।
আর তিন নম্বরটা এমন একটা জটিল জায়গা যেখানে টেকনিক্যালি সবচেয়ে সাউন্ড ব্যাটাররাই খেলে থাকেন। হ্যাঁ, অনেক আন-অর্থোডক্স ব্যাটারও খেলেছেন টেকনিককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, রান করা পূর্ণাঙ্গ নিশ্চয়তা ধরে রেখে – কিন্তু শান্ত সেটা পারছেন কোথায়। বরং দিনকে দিন তাঁর সমস্যাটা প্রকট হচ্ছে।
সমস্যাটা কি? সমস্যাটা হল তাঁর ব্যাট-প্যাডের মাঝে বেশ একটা জায়গা ফাঁকা। স্ট্যান্সে গলদ। যার কারণে নিয়মিত তিনি স্লিপ কর্ডনে বা উইকেটরক্ষকের হাতে ক্যাচ দিচ্ছেন। কখনও বা বোল্ড হচ্ছেন। এখানে সমস্যাটা তাঁর প্রতিভার না, সমস্যা টেকনিকে।
আর এই টেকনিকজনিত সমস্যা তো চাইলেই ঠিক করা যায়। সাকিব আল হাসান এই বয়সেও নিজের মত কি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তন আনছেন। সেখানে শান্তর বয়স আর কত। এখনই তো নিজেকে পাল্টানোর সঠিক সময়। এখন না শুধরালে আর কবে!
সমস্যাটা নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাতো না, যদি শান্তর ব্যাটে রান থাকতো। সমস্যাটা প্রবল, কারণ শান্ত রানও পাচ্ছেন না মোটেই। সাকিব আল হাসান তো বলেই দিয়েছেন, একশভাগ টেকনিক্যাল সাউন্ড ব্যাটসম্যান বাংলাদেশে নেই। এমনকি বিশ্বের খুব কম ব্যাটসম্যানই ক্রিকেটের ব্যাকরন পুরোপুরি অনুসরণ করেন। আর তাই টেকনিক নিয়ে যত আলোচনাই করা হোক, দিনের শেষে রান পাওয়া অথবা না পাওয়াটাই ব্যাটসম্যানের সফলতা নির্ধারণ করে। আর নাজমুল শান্ত সেই রানটাই পাচ্ছেন না।
আরেকটা সমস্যা হল, শান্ত আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন পুরনো দিনের মত। যেন এশিয়া কাপটাই আবার ফিরে এসেছে। কখনও কঠিন উইকেটে শুরু থেকেই পেটাতে চেষ্টা করেন। কখনও বা আবার মারার বলও ছেড়ে দেন। অনেক সময় মনে হয়ে উইকেটের চরিত্র না বুঝে স্রেফ আক্রমণ করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে চাচ্ছেন। আবার কখনও মনে হচ্ছে, মারার বলেও ডিফেন্স করে নিজের টেস্ট মানসিকতা বোঝাতে চাইছেন। এভাবে আর যাই হোক টেস্ট ক্রিকেট হয় না।
এসব বহুবিধ সমস্যার সমাধান হলে ভাল, কিন্তু না হলে আসলে শান্তর পেছনে যতই বিনিয়োগ করা হোক না কেন – তাঁকে বিদায় বরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না বাংলাদেশের সামনে। ইতিহাসে ‘একটি ভুল বিনিয়োগ’ হিসেবেই টিকে থাকবে নাজমুল হোসেন শান্তর নাম।