মরুর দেশে বালুঝড়। মুহূর্তে চারিদিক খানিকক্ষণের জন্য অন্ধকারে ছেয়ে গেল। তবে আসল ঝড় তখনও বাকি। তখনও ক্রিকেটের ঈশ্বরের ঝড় তোলা বাকি। যেই ইনিংস পরবর্তীতে স্বীকৃত হয়েছিল ‘মরুর ঝড়’। একটি মাঠের মাহাত্ম সেদিন বহুগুণে বাড়িয়ে দেন শচীন টেন্ডুলকার।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বাঘা বাঘা বোলার আর স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্নের বিপক্ষে ঝড়ের পর আরেক ঝড় তুলেছিলেন শচীন। ১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৪৩ রান করেছিলেন ১৩১ বলে। গড অব ক্রিকেটের একটি রেকর্ডের সাথে যুক্ত হয়ে গেল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়াম।
এর আগে অবশ্য আরেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার জাভদ মিঁয়াদাদ নিজের এক রেকর্ড গড়া পারফরমেন্সের সঙ্গী করেছিলেন শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে ২৪৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ১১৪ বলে ১১৬ রানের এক ইনিংস খেলে জয় ছিনিয়ে আনেন।
ভারতের ক্রিকেট সমর্থকদের বেদনাতুর এক স্মৃতির সাক্ষী যেমন এই ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ঠিক তেমনি গর্বেরও সাক্ষী। তাছাড়া পাকিস্তানের জন্যও বেশ গর্বের জায়গা শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়াম ক্রিকেট অঙ্গনে পার করে ফেলেছে চার দশক। শাহরাজ ক্রিকেট স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে। তবে আনুষ্ঠানিক যাত্রাটা শুরু ১৯৮২ সালে।
সেই সালে অবশ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়াম। শারজাহের ধনি ব্যবসায়ী আবদুল রহমান বুখাতির প্রতিষ্ঠা করেন সেই ক্রিকেট স্টেডিয়াম। তবে প্রতিষ্ঠার বছর দুই বাদে ক্রিকেট গড়ায় শারজাহের বাইশ গজে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার এশিয়া কাপের ম্যাচ দিয়ে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় আধুনিক শারজাহ।
তবে শারজাহ ক্রিকেট কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক মাজহার খান দাবি করেন ১৯৮১ সালে ভারত ও পাকিস্তানের দুই কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কার একাদশ ও জাভেদ মিঁয়াদাদ একাদশের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়াম তাঁর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। তবে যে ম্যাচ দিয়েই শুরু হোক না কেন আশি ও নব্বইয়ে দশকে ভারত পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বেশকিছু ম্যাচ আয়োজন করেছিল শারজাহ সে নিয়ে তর্কের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
সেই থেকে চার চারটি দশক ধরে নানান সব কীর্তির সাক্ষী হয়ে আছে শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়াম। তাছাড়া ক্রিকেট অঙ্গনে নতুন পদাচারণ করা আফগানিস্তানের ঘরের মাঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছে এই স্টেডিয়াম। তাছাড়া পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিষিদ্ধ হওয়ার পর পাকিস্তানের বহু ম্যাচ আয়োজনের সুযোগ হয়েছে এই শারজাহ ময়দানে।
এখন অবধি ২৪১টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ আয়োজন করে ফেলেছে শারজাহ। অথচ ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড ১৬১ ম্যাচ আয়োজন করেছে। মাত্র ৫০০০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার একটি স্টেডিয়ামে এখন প্রায় ১৬ হাজারের মতো দর্শক একসাথে বসে ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটটা উপভোগ করতে পারে।
তবে এই মাঠও সয়েছে নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা। ম্যাচ চলাকালীন ফিক্সিং হয় এমন কারণ দেখিয়ে শারজাহের বিরুদ্বে একজোট হয় বিশ্বের বড় বড় ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ। তারপর ক্রিকেট আয়োজনের নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়ে একটা লম্বা সময় অপেক্ষা করেছে শারজাহের বাইশ গজ ও সবুজ গালিচা।
২০১০ সালে আফগানিস্তান শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে তাঁদের বেসক্যাম্প বানায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাঁদের সব হোম সিরিজ আয়োজন করতো সেখান। এরপর থেকে ক্রিকেট আবার ফেরে শারজাহে, মরুর বুকে এক ফোঁটা সবুজের সমারোহ।
এরপর বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া তাঁদের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগও আয়োজন করে সেই মাঠে, ২০১৪, ২০২০ ও ২০২১ সালে। এর পাশাপাশি ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বেশ কয়েকটি ম্যাচ আয়োজন করার গৌরব অর্জন করেছে এই মাঠ।
শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের এই অগ্রযাত্রা চলতে থাকুক। চার দশকের যাত্রা দীর্ঘায়িত হোক চার শতকে কিংবা তারও বেশি।