তাঁকে নিয়ে বিস্ময়ে ভাসতেই হয়। তাঁর চিরায়ত ‘সুইং’ মুগ্ধতায় ডুব দিতে হয়। আবার তাঁর মাইল ফলক ছোঁয়ার গল্পগুলো কাব্য, মহাকাব্যের শব্দশৈলীতে যোগ করতে অনন্ত সময় অপেক্ষা করার সাধ জাগে। নামটা তাঁর জেমস অ্যান্ডারসন।
বয়স চল্লিশ পেরিয়ে একচল্লিশে ধাবমান। এমন বুড়োদের বৃত্তে বন্দী হওয়া বয়সে জেমস অ্যান্ডারসন যেন এখনও তরুণ। তারুণ্য দীপ্তি ছোটাচ্ছেন ক্যারিয়ারের এক ক্রান্তিলগ্নে এসেও। ‘ক্রান্তিলগ্ন’ বলাটা এক অর্থে ভুল হলো। কারণ অ্যান্ডারসনের ক্ষেত্রে বয়সটাই শুধু বেড়েছে। বয়সের সাথে তাঁর উইকেট তুলে নেওয়ার হার একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে। একই সাথে, সুইং বিষে স্ট্যাম্প ছত্রখান করার মূহূর্তের দৃশ্যও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
৪১ ছুঁইছুঁই বয়স, এমন এক বয়স যখন সিংহভাগ পেসাররা নিজেদের নামের পাশে ‘প্রাক্তন’ বসিয়ে দেন, পেস বোলিং কোচ কিংবা বোলিং পরামর্শক হিসেবে যারা পরবর্তী প্রজন্মের পেসারদের গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন, ঠিক সেই বয়সেই জেমস অ্যান্ডারসন পাল্লা দিচ্ছেন এ কালের তরুণ, সম্ভাবনাময় পেসারদের সাথে। সেটা কেমন? সেটা অতি দুর্দান্ত। আইসিসি টেস্ট র্যাংকিংয়ে ঠিক এই মুহূর্তে ইংলিশ এ পেসার আছেন বোলারদের র্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে। অবাক কিংবা বিস্ময়ে ভাসার জন্য এতটুকুই তো যথেষ্ট।
তবে এত টুকুতেই তো তাঁর কীর্তি গাঁথা বন্দী নয়। টেস্ট ক্রিকেটে জেমস অ্যান্ডারসনের ঝুলিতে ৬৮৫ টা উইকেট। ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁর চেয়ে বেশি টেস্ট উইকেট নেই আর অন্য কোনো পেসারের। এমনকি ইতিহাসে ৬০০ উইকেটের পেসারও কেউ নেই। এ তো গেল, উইকেটের কীর্তি।
২০ বছরের ক্যারিয়ারে ১৭৯ টেস্ট খেলেছেন, যা ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ তো বটেই, ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁর চেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছেন মাত্র একজন। তিনি শচীন টেন্ডুলকার। যিনি এই অ্যান্ডারসনের বলেই টেস্ট ক্যারিয়ারে বেশিবার আউট হয়েছেন।
২০০৩ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে লর্ডসে টেস্ট অভিষেক জেমস অ্যান্ডারসনের। তবে তার আগে ঐ বছরের বিশ্বকাপেই তাঁর ওয়ানডেতে অভিষেক হয়। যদিও একটা সময় পর টেস্ট ক্রিকেটই তাঁর ধ্যান জ্ঞান হয়ে যায়। ঐ টেস্ট ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরেই শেষ কয়েক বছর কাটাচ্ছেন।
যা হোক, টেস্ট ক্রিকেটের অভিষেকটাই রাঙিয়েছিলেন অ্যান্ডারসন। নিজের ১৮তম বলে জিম্বাবুয়ের ওপেনার মার্ক ভারমিউলিনকে বোল্ড করে লাল বলের ক্রিকেটে প্রথম উইকেটের দেখা পান তিনি। আর ঐ ইনিংসেই পান প্রথম ফাইফার। লর্ডসে অভিষেকেই ৫ উইকেট!
অনার্স বোর্ডে তাই নাম লেখানো হয়ে গিয়েছিল ঐ ম্যাচ দিয়েই। কে জানতো, যে লর্ডসে তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়েছিল, সেই লর্ডসেই তিনি এক সময় রাজ করবেন। দুই দশকের সময়কালে আগের সব রেকর্ড বদলে দেবেন নিজের আগ্রাসনে। লর্ডসের ইতিহাস বলে, লাল বলের ক্রিকেটে এই মাটিতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক জেমস অ্যান্ডারসন। ২৭ টেস্টে ১১৭ টা উইকেট। তাঁর আশেপাশে রয়েছেন শুধুই স্টুয়ার্ড ব্রড (১০২ টা উইকেট)।
অথচ, ইংলিশ এ পেসারের শুরুর গল্পটা কিন্তু ততটাও মসৃণ নয়। টেস্ট অভিষেকে ৫ উইকেট নিলেন বটে। কিন্তু একাদশে নিজের জায়গা তৈরি করতে পেরিয়ে গেল ৫ টা বছর। আর নিজের শততম উইকেটটা পেতে অপেক্ষা করতে হলো ২৯ টা টেস্ট! শুরুর এমন পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই কিংবদন্তিতূল্য কিছু নয়, খুবই গড়পড়তা মানের পরিসংখ্যান।
কিন্তু জেমস অ্যান্ডারসন বদলে গেলেন এরপর থেকেই। আস্তে আস্তে পরিণত হলেন। সমৃদ্ধ হতে শুরু করলো তাঁর ক্যারিয়ার। প্রথম ২৯ টেস্টে ১০০ উইকেট পেরোনো অ্যান্ডারসন পরের ১০০ টা উইকেটের জন্য এবার ম্যাচ খেললেন ২৬ টা। আর সময় নিলেন ২ বছর।
২০১০-১১ মৌসুমের অ্যাশেজে পিটার সিডলকে আউট করে সেই মাইলফলক স্পর্শ করলেন। একই সাথে হলেন, ইতিহাসের অংশও। দীর্ঘ ২৪ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে সেবার অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করেছিল ইংল্যান্ড। আর ঐ সিরিজে ২৪ উইকেট নিয়েছিলেন অ্যান্ডারসন।
ইংল্যান্ডের হয়ে ততদিন পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে ৩৮৩ টি উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক ছিলেন ইয়ান বোথাম। ২০১৫ সালে এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে এসে সেই রেকর্ড ভেঙ্গে দিলেন অ্যান্ডারসন।
ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক দীনেশ রামদিনকে ফার্স্ট স্লিপে ক্যাচ বানিয়ে ৩৮৪ নম্বর উইকেটের দেখা পেলেন।যার মধ্য দিয়ে ইয়ান বোথামকে টপকে ইংল্যান্ডের সর্বকালের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার বনে যান জেমস অ্যান্ডারসন।
এরপর একে একে ৪০০, ৫০০ ও ৬০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন ইংলিশ এ পেসার। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে স্পেশাল উইকেটটি ছিল ৫৬৪ নম্বর উইকেট। কারণ টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে পেসারদের মধ্যে ততদিন পর্যন্ত ৫৬৩ টি উইকেট নিয়ে শীর্ষে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাকগ্রা। ২০১৮ সালে কেনিংটন ওভালে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে মোহাম্মদ শামিকে বোল্ড করে গ্লেন ম্যাকগ্রাকে টপকে যান জেমস অ্যান্ডাসন।
এর দুই বছর বাদে, ২০২০ সালে পাকিস্তানের আজহার আলীকে আউট করে ইতিহাসের প্রথম পেসার হিসেবে ৬০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন জেমস অ্যান্ডারসন। এই মুহূর্তে টেস্ট ক্রিকেটে জেমস অ্যান্ডারসনের উইকেট সংখ্যা ৬৮৫ টি। অর্থাৎ ৭০০ উইকেট পেতে তাঁর আর অপেক্ষা ১৫ টি উইকেটের। আর শেন ওয়ার্নের ৭০৮ উইকেটকে ছাপিয়ে যেতে প্রয়োজন ২৪ টি উইকেট।
মুত্তিয়া মুরালিধরনের ৮০০ টা উইকেটের রেকর্ড হয়তো এই মুহূর্তে অ্যান্ডারসনের জন্য অনেক দূরের পথ। তবে জিমির একটা রেকর্ড বিস্ময় জোগাতে বাধ্য। সেটি হলো- বয়স ত্রিশ পেরোনোর পর তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ৪১৭ টা উইকেট নিয়েছেন। যে কীর্তি আর কারো নেই।
এজবাস্টনে অ্যাশেজের প্রথম টেস্ট শুরু হবে আগামী ১৬ জুন। কনুইয়ের চোটে পড়ে জোফরা আর্চারের অ্যাশেজ শেষ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। তাই আসন্ন অ্যাশেজে ইংলিশ পেসারদের নেতৃত্ব থাকার কথা অ্যান্ডারসনেরই। তবে অ্যান্ডারসন নিজে বেশ বাস্তববাদী থাকছেন। তাঁর মতে, অ্যাশেজের ৫ টেস্টের ৩ টিতে তিনি সুযোগ পেলেই সেটা হবে দারুণ। কারণ পেসারদের জন্য ৫ টা টেস্ট খেলা একটু বাড়াবাড়ি হয়েই যায়।
সামনের এই অ্যাশেজেই ৭০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁতে পারবেন কিনা, তা সময়ই বলে দিবে। তবে টানা ২০ বছর ধরে, জেমস অ্যান্ডারসন যেভাবে দৌর্দন্ড্য প্রতাপে বাইশ গজে ব্যাটারদের শাসন করছেন, তা ইতিহাসে বিরলই বলা চলে। অবশ্য বিরলতম রেকর্ড গুলোর শুরুই তো হয়েছে তাঁকে দিয়ে।
শেষটা করা যাক, বেন স্টোকসের একটা টুইট দিয়ে। সম্প্রতি ইংলিশ এ অধিনায়ক টুইট করেছেন, ‘জেমস অ্যান্ডারসনের যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরু, তখন আমি ১১ বছরের একটা শিশু।’ সেই শিশুই এখন ইংল্যান্ড টেস্ট দলকে সামলাচ্ছেন।
আর তাঁর দলের পেস বোলিং ত্রাতা হচ্ছেন জেমস অ্যান্ডারসন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মেলবন্ধন বুঝি এঁকেই বলে। আর সেই মেলবন্ধনের রাস্তাটা তৈরি করেছেন জেমস অ্যান্ডারসন। যার বোলিংয়ের সাক্ষী হয়েছে এই শতাব্দীর তিনটা ভিন্ন দশকের প্রজন্মরাই।
পেসাররাও চল্লিশ পেরিয়ে আগ্রাসন দেখাতে পারেন! জেমস অ্যান্ডারসনের কল্যাণেই সেই অসম্ভব ব্যাপারটা এখন সম্ভাব্যতায় রূপ নিয়েছে। এখন তরুণ পেসাররা চাইলেই একজন অ্যান্ডারসনের ক্যারিয়ার দেখে নিতে পারে, খুঁজে নিতে পারে অনুপ্রেরণা। কারণ অ্যান্ডারসন শুধু একজন কিংবদন্তি পেসার নন, পেসার হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা অনেক তরুণের অনুপ্রেরণার রসদও বটে।