শুভমান সাবধান

যদি উদ্ধৃত করার মতো স্টেটমেন্ট দেওয়ার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কারের বন্দোবস্ত থাকত, আমাদের দেশ থেকে তার সবচেয়ে জোরালো দাবিদার সম্ভবত হতেন অনিল রাধাকৃষ্ণ কুম্বলে। স্বল্প শব্দের পরিমিত ব্যবহারে একটি লাগসই মন্তব্য করার ক্ষমতা তাঁর ঈর্ষণীয়।

যদি উদ্ধৃত করার মতো স্টেটমেন্ট দেওয়ার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কারের বন্দোবস্ত থাকত, আমাদের দেশ থেকে তার সবচেয়ে জোরালো দাবিদার সম্ভবত হতেন অনিল রাধাকৃষ্ণ কুম্বলে। স্বল্প শব্দের পরিমিত ব্যবহারে একটি লাগসই মন্তব্য করার ক্ষমতা তাঁর ঈর্ষণীয়।

সেই অনিল কুম্বলে একবার শচীন এবং তাঁর ক্রিকেট-ভবিতব্য নিয়ে তুলনামূলক একটি মন্তব্য করেছিলেন যা শুধু ক্রিকেট-লোকগাথায় উল্লেখের দাবি রাখে না, ক্রিকেটানুরাগী শিক্ষার্থীদের ভাব-সম্প্রসারণের টাস্ক হিসেবেও দেওয়া যায়।

অনিল বলেছিলেন, তিনি নিজে যেমন প্রায় পুরো কেরিয়ার কাটিয়েছেন তাঁর সম্বন্ধে লোকের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে, শচীন তাঁর ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময়টাই কাটিয়েছেন লোকের তাঁর সম্বন্ধে হয়ে থাকা ধারণাকে ঠিক প্রমাণ করতে।

ভেবে দেখার মতো। শচীন সম্বন্ধে সবাই জানতেন, তিনি ব্যাট হাতে ধরার মুহূর্ত থেকে সানির লেগ্যাসি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চিহ্নিত। তাঁর রাজবেশ, রাজদণ্ড, সিংহাসন ও মুকুট ইতোমধ্যেই প্রস্তুত। তাঁকে শুধু রাজ্যাভিষেকের সময়ে ঠিকঠাক পৌঁছতে হবে। সবাই জানত, তিনি বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হতে চলেছেন। তাঁকে শুধু সেটা হয়ে দেখাতে হবে।

এ বড় সহজ ভার নয়। আপনি লিওনেল মেসিকে জিজ্ঞাসা করুন; জিজ্ঞাসা করুন ম্যাগনাস কার্লসেনকে – যারা এটা সম্ভব করে দেখিয়েছেন। জন্মলগ্ন থেকে ‘দ্য চোজেন ওয়ান’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার পরে প্রত্যাশা পূরণ না করতে পারার হতাশা, যন্ত্রণা আর আক্ষেপের চোরাবালির তলটান নিয়ে জানতে চান রাহুল গান্ধী বা অভিষেক বচ্চনকে।

বুঝতে পারবেন যে সাফল্যকে সবাই আপনার জন্য ‘টেকন ফর গ্র্যান্টেড’ ধরে নিয়েছেন, সেটিকে দু-হাতে আঁকড়ে রাখার জন্য, প্রতিবার অর্জন করে নেওয়ার জন্য কী অমানুষিক লড়াইটাই না লড়তে হয় এদের।

মনে মনে নিশ্চিত জানেন, অন্য সকলের মতো ‘দ্বিতীয় সেরা’-র কোনো পুরস্কার নেই তাঁদের জন্য। হয় তুমি সর্বোচ্চ, না হলে তুমি কিস্যু পারোনি – এই প্রাণান্তকর বাইনারি তাঁদের রোজের জীবনের শ্বাসপ্রশ্বাস – আর সেটা একদম শুরুর দিন থেকেই।

ব্যর্থ হলে শুধু তো তোমার স্কিলের, তোমার অ্যাবিলিটির ওপর নয়, তোমার জীবন-চর্যা, তোমার সার্বিক অস্তিত্বের ওপরেই মোটা-মোটা দাগের প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে এরই মধ্যে অল্প বিস্তর শুভমান গিলও জানেন; অন্তত জানেন, এমনটাই আশা করছি। যদি না জানেন, যদি খেয়াল না পড়ে এখনও – তাহলে কিছুদিনের জন্য ইনস্টাগ্রাম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে, নির্মেদ, পেশিবহুল অ্যাবস এবং ছেনি-বাটালি দিয়ে কুঁদে নিখুঁত করা চোয়াল দেখে নালে-ঝোলে হওয়া আমোদগেঁড়ে ফ্যানদের সম্মিলিত ক্যাকোফোনি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেই আশা করি শুনতে পাবেন।

তিনি এ-ও নিশ্চয়ই জানেন তিনি দৃষ্টিনন্দন। যে আনন্দ পাওয়ার জেরে আমরা ৩টে গ্র্যান্ডস্ল্যাম বেশি জেতা অল-সারফেস প্লেয়ারটিরও আগে অবসৃত সুইস-প্রৌঢ়কে বসিয়ে ফেলি, যে আনন্দটুকুর সন্ধানেই আমরা দাঁত-উঁচু, পনিটেল, খামখেয়ালি ব্রাজিলিয়ানকে হৃদয়ের বেশি কাছাকাছি রেখে দিই, যে অহৈতুকী আনন্দ, যে অপরিমেয়, পরিসংখ্যান দ্বারা অসংজ্ঞেয় আবেগই শেষমেশ ‘ছা.গ.ল’ তর্কের ডিসাইডার হয়ে দাঁড়ায় সব খেলাতেই – শুভমান জানেন, সেই সৌন্দর্যের চাবিকাঠি রয়েছে তাঁর খেলায়।

তাঁর ঝুঁকে পড়ে করা মসৃণ ড্রাইভ, শর্ট-আর্ম জ্যাব-পুল, তাঁর নিখুঁত বৃত্তচাপে ঘুরে যাওয়া ব্যাটের ফলো-থ্রু থেকে ঝরে পড়া সুষমার ফোঁটা নি:শেষে শুষে নিতে হাপিত্যেশ বসে থাকে আইপিএল আক্রান্ত, পাওয়ার-হিটিংপীড়িত ক্রিকেটভক্তের চোখ।

ক্রিকেট দুনিয়ার সবাই জানেন, তিনি এসেইছেন জয় করার জন্য। সবাই জানেন, তিনি রান করবেন, ম্যাচ জেতাবেন, হৃদয় জিতবেন লক্ষ-লক্ষ ক্রীড়াপ্রেমীর।

কিন্তু স্বয়ং গিল জানেন কি যে তিনি এখনো এসব কিছুই করে ওঠেননি; তাঁকে এসব করতে হবে। একদিন নয়, একবার নয়, প্রতিদিন, প্রত্যেক বার?

তিনি কি জানেন, তিনি নিছক একজন ব্যাটসম্যান নন, যেমন ম্যাগনাস কার্লসেন স্রেফ একজন দাবাড়ু নন বা লিও মেসি নন শুধুমাত্র একজন ফুটবলার। তিনি কি জানেন তাঁর ব্যর্থতার মাপকাঠি অন্য আর পাঁচ জনের মতো নয়, হবে না। তাঁর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ফর্মুলা হল: (তাঁর সাফল্যের প্রতি সীমাহীন প্রত্যাশা – ডেল্টা)!

তিনি কি জানেন, তাঁর শক্ত হয়ে থাকা বটম হ্যান্ড, তাঁর পিচে পড়ে স্লো হওয়া ডেলিভারির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অস্বাচ্ছন্দ্য, তাঁর পঞ্চম স্টাম্পের বলে ড্রাইভ করার ইচ্ছে, তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিজের প্রভাব বিস্তার করার অসামর্থ্য – এ সব কার্য-কারণ বিশ্লেষণ ছাপিয়ে শুধু একটা অবোধ দাবিই পিচ জুড়ে রাজত্ব করবে, তাঁর কেরিয়ার চলাকালীন – ‘আরও একটু থেকে যেতে পারত!’

আমরা জানি, ক্রিকেটে তাঁর সময় শুরু হয়ে গিয়েছে সেই ব্রিসবেন থেকেই। স্বয়ং শুভমান গিল কি জানেন, তাঁর সময় ফুরিয়েও আসছে অতি দ্রুত? জানলে, নিতান্ত এলেবেলে-মার্কা এরকম একটা সিরিজ কি অকারণে বয়ে যেতে দিতেন?

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...