নরম্যান হোয়াইটসাইড, পল ম্যাকগ্রা আর ব্রায়ান রবসন- ওল্ড ট্রাফোর্ডের তিন মোক্ষম অস্ত্র যেন ভোঁতা হয়ে গেছে মৌসুমের শুরু থেকেই। ইংল্যান্ডের বোহেমিয়ান জীবন যাত্রায় গা ভাসিয়ে দেদার মদ্যপান করে ফিটনেস লেভেল তলানিতে। ম্যানেজমেন্ট যখন অ্যালেক্স ফার্গুসনকে নিয়ে এলেন ম্যানেজার করে তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪৫।
১৯৮৬ সাল। লিগে রেড ডেভিলসদের অবস্থান ২১ নম্বরে। মাঝ মৌসুমে হালকা চেহারার লাজুক ফার্গি পা রাখলেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে। বিরক্ত ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের তারকারা দম্ভের বশে ধরেই নিলেন যে ছেলেটা খেলোয়াড় জীবনে স্কটিশ লিগ খেলে ম্যান ইউ-এর হট সিটে বসেছে তাঁর গদিচ্যুত হওয়া সময়ের অপেক্ষা।
‘গেট আউট অব দ্য ফিল্ড’ – গলাটা পাতলা হলেও জোর বেশ। থমকে গেলেন ম্যাকগ্রা আর রবসন। প্রথম প্র্যাকটিসে দেরী করে আসতেই নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন অ্যালেক্স! হকচকিয়ে গেল সকলে। ফার্গি উঠে দাঁড়ালেন – ওল্ড ট্রাফোর্ডের সাইড লাইন বরাবর পৃথিবীকে দুভাগ করে দিলেন এক দৃপ্ত ফুটবল বিজ্ঞানী।
নিজের চ্যালেঞ্জ ধরে রেখে ২১ নম্বর থেকে ১১ নম্বরে নিয়ে এসে মৌসুম শেষ করলেন ফার্গুসন। ঘোষণা করে দিলেন, ‘ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের উর্ধ্বে কেউ নয়। এখানে থাকতে হলে নিয়ম মেনে থাকতে হবে নচেৎ দরজা খোলা আছে!’
নিজেদের ক্লাবের উর্ধ্বে ভেবে ফেলা ম্যান ইউ তারকারা যেন এক ধমকে শান্ত হয়ে গেল। তালিকায় রইলেন – ব্রায়ান ম্যাকলরেন, জ্যাসপার ওলসেন, ভিভ অ্যান্ডারসনের মত তারকারা। শুরু হল ইংল্যান্ডে ফার্গুসনের সম্মোহন।
পরের মৌসুম থেকেই যেন সোনালি দৌড় শুরু করলেন ফার্গি। গোঁড়া ব্রিটিশ সমর্থকদের মাত করলেন নিজের যাদু দণ্ডে, শক্তিশালী লিভারপুলের থেকে ৯ পয়েন্ট পেছনে থেকে দ্বিতীয় হল ম্যান ইউ। নিজের নোটবুকে কী লিখতেন স্যার ফার্গি? হয়ত ফুটবল বিজ্ঞানের কোনো জটিল ক্যালকুলাস যা সবুজের ওপর বিছিয়ে দিত সুর তাল লয়ে বাঁধা অর্কেস্ট্রার মিউজিক।
১৯৮৯-৯০ তে প্রথম এফএ কাপ, ৯২-৯৩ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ- অদম্য ফার্গির রথের চাকায় দুলে উঠল ব্রিটিশ ফুটবলের আঁতুরঘর। ৮৬ সালের সেই ধুঁকতে থাকা ম্যানচেস্টারের রঙ পাল্টে দিলেন স্কটিশ ম্যাজিশিয়ান। একের পর এক খেলোয়াড় আসতে শুরু করলেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে, এরিক ক্যান্টোনা থেকে রায়ান গিগস, পল স্কোলস থেকে ডেভিড বেকহ্যাম-ফার্গির শিরায় শিরায় চুইয়ে পড়া আভিজাত্য আর পিতৃ-সুলভ শাসন আর ভালবাসায় বশ শিকার করলেন ডেভিড বেকহ্যাম-ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মত তারকারা।
মৌসুম শেষ হলে ইউরোপের বিভিন্ন লীগে ঘুরে ঘুরে জহুরির চোখ দিয়ে তুলে আনতে শুরু করলেন ওল্ড ট্রাফোর্ডের সম্রাট!
১৩ টা প্রিমিয়ার লিগ, পাঁচটা এফএ কাপ, দু’টো ইউসিএল- ফার্গির ট্রফি ক্যাবিনেটে ম্যাঞ্চেস্টারের রঙ হয়ে গেল লাল। ইংল্যান্ডের অনেক ক্লাবের কাছে যা স্বপ্ন তা নিজের নোটবুকের জটিল অঙ্কে সমাধান কিরে ফেলেছিলেন ফার্গুসন, ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গ্রাসরুট একবার লিখেছিল যে ফার্গুসনের কাছে যা ট্রফি আছে হয়ত বাকি সব ক্লাবকে লোনে দিলেও ম্যান ইউ এক নম্বরে থেকে যাবে ট্রফি সংখ্যার বিচারে।
টালমাটাল ম্যান ইউ-এর রাশ আলগা করে চলে গেলেন ফার্গি, সময়ের রথ যেন সরিয়ে নিল তাকে প্রাণের ওল্ড ট্রাফোর্ড থেকে। ২০১৩ থেকে ফের যেন কালো ছায়া নামল কোটি কোটি রেড ডেভিলসের মনে। পোগবা-লিঙার্ড-র্যাশফোর্ডদের ফুটবলের বাইরের জীবনকে শৃঙ্খলায় বেঁধে দিয়ে একটা দ্বিতীয় রোনাল্ডো-বেকহ্যাম-রুনি-ওয়েন-ক্যারিক-ক্যান্টোনা-গিগস বানাতে পারছে না কেউ, হারিয়ে যাচ্ছে কত খেলোয়াড়- অভিভাবকের মহীরূহের ছায়া না শুকিয়ে যাচ্ছে একটা প্রজন্ম।
ফার্গি দূর থেকে দেখেন। সময় বড় কঠিন জিনিস তাকে আটকে রাখা যায় না। এখনো কোনো খেলোয়াড় বাড়াবাড়ি করলে হাতের মুঠোটা শক্ত করে ওঠে, ইচ্ছা করে গিয়ে বলে- নিয়ম আর অনুশাসনে থাকতে পারলে এই ক্লাব তোমার নইলে!
আজও একটা জয় হয়ত একটা বিদ্যুতের ঝলক। ৮৬-এর উত্তপ্ত সময়ে, টালমাটাল সময়ে যেমন ঝলক হয়ে এসেছিলেন স্কটিশ তেমনই – তবু এই সব দিনগুলোই ফিরিয়ে নিয়ে যায় স্মৃতির গালিচায় যেখানে হাতে বাঁশি নিয়ে মাঠে নামেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন – পৃথিবীর সমস্ত ফুটবলারের অভিভাবক হয়ে কাঁধে হাত রাখেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে যতদিন ফুটবল খেলা হবে লাল আবিরের এই দিনে বেঁচে উঠবেন স্যার আলেক্স।
প্রেসবক্সে মিডিয়ার সামনে কেউ আবার বলবে – ‘ট্রফিটা যাই হোক না কেন, এটা আমাদের জিততেই হবে!’