১.
কোন একটা সমস্যা সমাধান করতে চাওয়ার প্রথম স্টেপটা কি জানেন? সমস্যাটা চিহ্নিত করা।
এরপর? এরপর সমস্যাটা সমাধান করতে চাওয়ার উপায়টা জানা। এরপর? সমাধান করতে চাওয়া।
আপনি কোন একটা সমস্যা সমাধান করতে চাইলেন কিন্তু সমস্যাটা ধরতেই পারলেন না তাহলে তো আরো বড় সমস্যা। এরপর যদিও বা আপনি সমস্যাটা ধরতে পারলেন কিন্তু সমাধান করার উপায় টা জানা নেই তাহলেও কিন্তু সমাধান করা সম্ভব না।
তবে এর চাইতেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে আপনি চাচ্ছেন কিনা সমস্যার সমাধান করতে? না চাইলে আগের দুটো ক্রাইটেরিয়া পূরণ করেও লাভ নেই।
আলোচনার খাতিরে ধরে নিলাম আমরা চাচ্ছি সমস্যার সমাধান করতে। এখন আসা যাক সমস্যা নিয়ে। আমাদের সমস্যাটা আসলে কি?
২.
আমাদের সমস্যাগুলোর প্রথমে একটা তালিকা করার চেষ্টা করা যাক –
- আমাদের লিটন দাস-সৌম্য সরকার ভালো ব্যাটার না, কেবলমাত্র প্রতিভার তকমা দিয়েই দলে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
- তামিম কিংবা নাঈম শেখকে দিয়ে চলে না। এরা রান করলেও স্ট্রাইক রেট খারাপ। এত স্লো খেলে টি-টোয়েন্টি তে টিকে থাকা যায় না।
- সাকিব দেশের জন্য খেলে না, নিজের জন্য খেলে। টাকার জন্য খেলে।
- মুশফিককে দল থেকে বাদ দেওয়া উচিত। কিংবা খেলালেও নিচের দিকে। ওর জায়গায় আফিফকে খেলানো উচিত।
- মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বুড়ো হয়ে গিয়েছে। ডিফেন্সিভ ম্যান্টালিটির ক্যাপ্টেন। মুখস্ত কিছু থিউরি দিয়ে আর যা হোক আজকালকের টি-টোয়েন্টি চলে না।
- মুস্তাফিজের দিন শেষ বলে দাবি করছেন কেউ কেউ। ওর কাটার আর স্লোয়ার সবাই ধরে ফেলসে। নতুন কিছু করতে হবে ওর বোলিং নিয়ে নয়তো বাদ দিয়ে নতুন কাউকে আনতে হবে ওর জায়গায়।
যদি ভুল বলে না থাকি তাহলে সমস্যা মোটামুটি এই কয়েকটার মাঝেই ঘোরাঘুরি করবে।
কারো কাছে এই ৬ টা পয়েন্টের মাঝে হয়তো ১ টা সমস্যা, কারো কাছে হয়তো ২ টা কিংবা কারো কাছে সবগুলোই। কারো কাছে হয়তো এর বাইরেও কিছু সমস্যা ধরা পড়েছে।
ধরা যাক আমরা সমস্যা ধরে ফেলেছি। এখন সমাধানের উপায় কি? সেটা কি আমরা জানি? একটু কষ্ট করে সমাধান খোজার চেষ্টা করা যাক তাহলে।
৩.
প্রথমে এক আর দুই নম্বর সমস্যার দিকে তাকানো যাক যেহেতু দুটি সমস্যাই ওপেনারদের কে নিয়ে।
লিটন আর সৌম্যকে নিয়ে যে অভিযোগ সেটা কিন্তু মিথ্যে নয়। তামিম কিংবা নাঈমের ব্যাপারে যা বলা হচ্ছে সেগুলোও সত্য।
তাহলে সমাধানের উপায় কি? দুটো উপায় আছে।
প্রথমটা হচ্ছে এদের রিপ্লেসমেন্ট খুজে বের করা। কিন্তু আসলেই কি আমাদের হাতে এই চারজনের চাইতে ভালো ব্যাটার রয়েছে?
ঘরোয়া ক্রিকেট সেভাবে ফলো করা হয় না বিধায় বলতে পারছি না তবে লিটন, সৌম্য কিন্তু নিজেদেরকে কিছু কিছু জায়গায় প্রমাণ করেছিলেন বিধায়ই তাদেরকে দিনের পর দিন এত সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
নতুন কেউ আসলেও কিন্তু ফল পাবার জন্য আবার অপেক্ষা করতে হবে। এতটা ধৈর্য্য কি আমাদের আছে? আর দ্বিতীয় টা হচ্ছে দলের মাঝে থেকেই অন্য কাউকে মেক শিফট ওপেনার বানানো।
অরবিন্দ ডি সিলভা কিংবা ইনজামাম উল হকের মতো পিউর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানও কিন্তু ক্যারিয়ারের কোন কোন পর্যায়ে ওপেন করেছেন। কখনো দলের প্রয়োজনে, কখনো নিজের ক্যারিয়ারের প্রয়োজনে।
আমাদের ক্ষেত্রেও কি এটা সম্ভব নয় যে সাকিব কিংবা মুশফিককে দিয়ে ওপেন করানো? বলছি না এটাই পারফেক্ট সমাধান। তবে এটাও একটা সমাধানের পথ সেটা তো স্বীকার করা যেতেই পারে।
তামিমের ক্ষেত্রে কিছু বলার নাই। আপাতত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে উনার কথা না ভাবাই উচিত৷ তবে নাঈমকে নিয়ে ভাবা যায়। ওকে গ্রুমিং করে কিভাবে আরো উন্নতি করতে হবে সেদিকেই নজর দেয়া উচিত।
এখন যাওয়া যাক পরের পয়েন্টে।
৪.
পরের তিনটি পয়েন্ট মূলত দলের তিন সিনিয়রকে নিয়ে; সাকিব, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ। এই তিনজনকে নিয়ে আলোচনা করার আগে ক্রিকেট সম্পর্কে বেসিক কিছু বিষয় জানা উচিত।
সিনিয়রদের কাজ কিন্তু শুধু রান করা কিংবা উইকেট নেওয়া নয়। বরং একই সাথে দলের জুনিয়ররা কোন পজিশনে কমফোর্ট ফিল করে সেটা বুঝে নিজেদের জায়গাটাকে শাফল করে নেওয়া। কোন সন্দেহ নেই যে মুশফিক কিংবা মাহমুদউল্লাহ এই কাজটা করতে পারছেন না।
এই জায়গা গুলো নিয়ে আসলে অনেক আগে থেকেই ভাবা উচিত ছিল। অনেক দেরি হলেও ওখন আবার ভাবা উচিত। প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগুনো উচিত।
সাকিবের বিষয় নিয়ে বলার কিছু নেই। দলের একমাত্র ধারাবাহিক পারফর্মার। কিন্তু এটাও সত্য যে দলের অন্যান্যদের অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্স এর কারণেই তাঁর পারফরম্যান্স এতটা হাইলাইটেড। বড় দলগুলোতে সাকিব যে এভাবে সুযোগ পাবেন না বা পেলেও তেমন কিছু করতে পারবেন না সেটার প্রমাণ আইপিএল।
বাকি থাকে মাহমুদুল্লাহর ক্যাপ্টেন্সি। এই অভিযোগটা মোটামুটি সত্য। তবে সাকিব আর মাশরাফি বাদে তেমন অধিনায়ক আর বাংলাদেশ দলে এসেছেই বা কবে?
৫.
উপরের সমস্যা গুলো মোটামুটি আলোচনা করে যা বুঝা গেল তাতে মনে হচ্ছে আমাদের একাদশের বেশির ভাগ খেলোয়াড়দের বাদ দিয়ে নতুন কাউকে নেওয়াটাই হয়তোবা সমাধান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের পাইপলাইনেও আসলে এদের বিকল্প কেউ তৈরি নেই।
তাহলে সমাধানটা আসলেই কি? যেহেতু সমস্যাও আছে আর সমাধানও করতে পারছি না তাহলে মেনে নেওয়া উচিত যে আমরা আসলে সমাধানের পথটা খুজে পাচ্ছি না।
এখন তাহলে একটু ভিন্ন ভাবে ভাবার চেষ্টা করা যাক।
এটাতে কোন সন্দেহ নেই যে লিটন, সৌম্য, মুস্তাফিজ কিংবা দল থেকে বাদ পড়া নাসির, সাব্বির কিংবা রুবেল এদের সবাই যথেষ্ট প্রতিভাবান। ছোট ক্যারিয়ারে লিটন, সৌম্য, মুস্তাফিজ রা যে কিছু চমক দেখিয়েছেন সেটা অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররাও দেখাতে পারেন না।
এই ধরণের খেলোয়াড়দের তৈরি করা যায় না, এরা জন্মায়। তবে সমস্যা হচ্ছে উপরওয়ালার দেওয়া এই গিফটগুলোকে আমরা ধরে রাখতে পারছি না।
এই ধরে রাখতে না পারার জন্য মূল দায়টা কিন্তু খেলোয়াড়দের নয়। তাহলে দায়টা কার? সেটা নিয়ে না হয় কিছু আলোচনা করা যাক।
৬.
ব্যাটিং করা কিংবা বোলিং করাই একজন খেলোয়াড়ের একমাত্র কাজ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং করা।
১০ ওভারে শূন্য উইকেটে ৮০ রান করার পরিস্থিতিতে ব্যাট করা আর ১০ ওভারে ৫ উইকেটে ৪০ রান করার পরিস্থিতিতে ব্যাট করা মোটেও এক কথা নয়।
৩ ওভারে ৪৫ রান প্রয়োজন এমন অবস্থায় বল করা আর ৩ ওভারে ১৫ রান প্রয়োজন এমন অবস্থায় বল করার মাঝেও পার্থক্য আছে।
সমস্যা হচ্ছে আমরা কি আমাদের খেলোয়াড়দের কে এমন ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি করাতে পারছি? পারছি না।
প্রতিযোগিতায় ভালো করার পূর্ব শর্ত হচ্ছে প্রস্তুতি যথা সম্ভব নেওয়া। আমাদের প্রস্তুতি কি যথেষ্ট?
এখন এই প্রস্তুতি পর্যাপ্ত না হওয়ার পেছনে কি শুধুই ক্রিকেটারদের দোষ? শুধু পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব নয়, পাইপলাইনে পর্যাপ্ত খেলোয়াড়ের যোগান না আনতে পারাটাও আমাদের একটা সমস্যা।
আমাদের দলে খুব কম খেলোয়াড়ই পারফর্ম করে জায়গা পায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্য খেলোয়াড়ের ব্যার্থতার কারণে জায়গা পায় এবং একটা সময় নিজেরাও ব্যর্থ হতে থাকে।
একটা পর্যায়ে আমরা শুধুমাত্র ব্যর্থ খেলোয়াড়দেরকেই আমাদের আশেপাশে দেখতে থাকি।
৭.
ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে মনে হয় সমস্যা সমাধান করার জন্য যথেষ্ট দক্ষ মানুষ আমাদের হাতে নেই।
দায়টা শুধুমাত্র খেলোয়াড়দের নয়, বরং মূল দায়টা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপরেও যায়।
বর্তমান পরিস্থিতি তে আমাদের হাতে যে ১৫ জন খেলোয়াড় আছেন স্কোয়াডে, মানতে হবে তারাই আমাদের সেরা খেলোয়াড়।
এখন এই দেশের খেলোয়াড়দেরকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সেরা খেলোয়াড় বানানোর জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন কিংবা পাইপলাইনে পর্যাপ্ত খেলোয়াড় রেখে যে চাপটা সৃষ্টি করা প্রয়োজন স্কোয়াডে সেটা ম্যানেজমেন্ট করতে পারেনি।
সবাই সাকিব আল হাসান নন যে এর মাঝেও নিজের একটা আলাদা অবস্থান তৈরি করে নিতে পারবে। ব্যর্থতার এই দায়টা তাই প্রথমে ম্যানেজমেন্ট কেই নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।