২৪ মার্চ, ২০১১, আহমেদাবাদের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল স্টেডিয়ামে দশম ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি দুই প্রবল প্রতিপক্ষ ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন টানা তিনটি বিশ্বকাপ জয় করে টানা চারটি বিশ্বকাপ জয়ের সরণীতে তরতরিয়ে এগিয়ে চলছে। অন্যদিকে আগের বিশ্বকাপে খারাপ ফল করে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু মহেন্দ্র সিং ধোনির ওই দল ঘরের মাঠে দ্বিতীয় বার সোনালী সুদৃশ্য ট্রফিটি নিজেদের হাতের তালুবন্দী করবার প্রচেষ্টায়।
প্রথমে ব্যাট করে অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের অনবদ্য সেঞ্চুরিতে ২৬১ রানের লক্ষ্যমাত্রা রাখে অস্ট্রেলিয়া। শুরুতে বীরেন্দ্র শেবাগ ফিরে গেলেও শচীন টেন্ডুলকার ও গৌতম গম্ভীরের অসাধারণ ইনিংসে পরবর্তী ধাপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় দল। এমন সময় দ্রুত কয়েকটি উইকেট হারিয়ে ম্যাচ থেকে হারিয়ে যাওয়ার মুখে।
৭৫ বলে ৭৪ রান বাকি এমন সময় যখন গোটা টুর্নামেন্টে অফ ফর্মে থাকা অধিনায়ক প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন তখন উল্টোদিকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় একজন সাথীর অপেক্ষায় ম্যাচটিকে ভারতের পক্ষে নিয়ে আসবার জন্য। এমন ম্যাচেই তো জন্ম হয় নায়কদের। প্রতিযোগিতার শুরুতে সুযোগ না পেলেও সুযোগ পাওয়ার আর তার সদ্ব্যবহার করবার অপেক্ষায় ছিলেন ছোটখাটো চেহারার এক অসাধারণ বাঁ-হাতির।
প্রথমে ব্রেট লিকে লং অনের উপর দিয়ে অসাধারণ ওভার বাউন্ডারি, পরে মিশেল জনসনকে পুল করে ফাইন লেগ দিয়ে বাউন্ডারি মেরে দলকে জয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে গেলেন তখন উল্টো দিকে ম্যাচের আসল নায়ক আনন্দে উদ্বেলিত সঙ্গে গোটা ভারতীয় দল। সেই ম্যাচের সাথে সেমিফাইনালেও নিজের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের নমুনা দেখিয়ে দলকে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত হয়েছিল দুই এপ্রিল, ২০১১ সালে, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে।
তিনি হলেন সুরেশ কুমার রায়না। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলবার বাসনায় জন্মস্থান মুর্দানগর, গাজিয়াবাদ থেকে লক্ষ্ণৌতে এসেছিলেন এক স্বপ্ন সঞ্চারী হয়ে। আর শুরুটাও সেই রকমই করেছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলে নিজের স্থান করা দিয়ে শুরু। এরপর অনূর্ধ্ব- ১৯ বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফরম্যান্স, আর তাতেই ভারতীয় দলে ১৯ বছরে সুযোগ এবং অভিষেক। অসাধারণ ব্যাটসম্যানের সাথে পার্টটাইম বোলিং করবার ক্ষমতা এবং সর্বোপরি অসাধারণ ফিল্ডার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন এই অভিষেককে আরও তরান্বিত করেছিল রায়নার।
ওযানডে অভিষেকে শূন্য তথা ডাক দিয়ে শুরু করলেও টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি করবার মধ্য দিয়ে ভারতের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে তিন ধরনের ফরম্যাটে সেঞ্চুরি করা প্রথম ক্রিকেটার হয়েছিলেন। কিন্তু এত কিছুর পরও টেস্ট ক্রিকেটে নিয়মিত হতে পারেননি শর্ট বল ও কোয়ালিটি অ্যাটাকের বিরুদ্ধে দূর্বল টেকনিকের মতোই, একেবারে যুবরাজ সিংয়ের মতোই যার চোটের কারণেই তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়েছিল। সীমিত ওভারের একজন অসাধারণ ক্রিকেটার ও অসাধারণ ফিনিশার হয়েই পরিচিতি রয়ে গেলো।
প্রতিভার খামতি রায়নার মধ্যে কোনোদিন ছিল না। কিন্তু শুরুর দিকে তেমন কিছু করতে পারেননি। সেজন্য ২০০৭ সালের কোনো বিশ্বকাপ দলেই তাঁর স্থান হয়নি। কিন্তু, এরপর যখনই সুযোগ পেয়েছেন নিজেকে প্রমাণ করেছেন, তৈরী করতে পেরেছেন যুবরাজের লাইক-টু-লাইক রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে। ম্যাচ শেষ করে আসবার অসাধারণ ক্ষমতা রায়নার মধ্যে বারবার দেখেছি আমরা।
২০১৫ বিশ্বকাপের পর পারফরম্যান্সে ঘাটতি এসেছে। তাও হয়তো ভেবেছিলেন ২০১৯ বিশ্বকাপ দলে সুযোগ হয়তো পেতে পারেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। আর সেই কারনেই হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন, যদিও এই সিদ্ধান্তে প্রিয় বন্ধু, সব সময়ের সাথী মহেন্দ্র সিং ধোনির ছেড়ে যাওয়ায় প্রভাব ফেলেছে প্রধানত।
কিছু কিছু ক্রিকেটার আছেন যাদের মাঠে উপস্থিতিই মন ভাল করে দেন, রায়না সেই ধরনের ক্রিকেটার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তাঁর কাভারের উপর দিয়ে মারা অসাধারণ সব শট, কিংবা পায়ের বলকে ফ্লিকে মাঠের বাইরে ফেলে দেওয়া মিস করছে। মিস করছে পয়েন্ট কিংবা কভার থেকে এক পলকে থ্রো করে উইকেট ভেঙে দেওয়া কিংবা ড্রাইভ দিয়ে অসাধারণ সব ক্যাচ ও ফিল্ডিং।