বিরহী সেতারের সুর

দিনটা ১৯৯৪ সালের ১৭ জুলাই । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার রোজ বোল স্টেডিয়াম।

আনন্দে মাতোয়ারা হলুদ জার্সিধারীরা। উল্লাস করছেন রোমারিও, দুঙ্গারা। কয়েক মুহূর্ত আগেই খেলা শেষ হয়েছে। চ্যাম্পিয়ন হয়ে  চতুর্থবারের মত বিশ্বকাপ ঘরে তুলল ব্রাজিল। এই উচ্ছ্বসিত হলুদ জার্সিধারীদের থেকে কিছুটা দূরে পেনাল্টি বক্সের সামনে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন ‘পনিটেল’ চুলের এক যুবক।

আগের বছরের ব্যালন ডি’অর ও ফিফা বর্ষসেরা বিজয়ী  ছিল সে। এই বিশ্বকাপেও পাঁচটা গোল আছে তার। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড আগেই তার ফুটবল ক্যারিয়ারে নেমে এসেছে এক চরম বিপর্যয়। ভাগ্যনির্ধারনী পেনাল্টি শটটা নিতে যাওয়ার আগেও তার ছিল একটা দেশের ফুটবল নায়ক। আর তারপর? সেকেন্ডের ভগ্নাংশেই নায়ক থেকে খলনায়কে রূপান্তর।

যুবকটির নাম রবার্তো ব্যাজ্জিও।

আরেকটা গল্পটা শোনা যাকে। ২০০৩ সালের ২৩ মার্চ। বসন্তের বিকেল শেষে সন্ধ্যা নামছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। সূর্যে ধীরে ধীরে  ঢলে পড়ছেন পশ্চিম দিগন্তে। জোহানেসবার্গ স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে দেখা গেল এক মারাঠী যুবককে। দু চোখে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি।

পুরো টুর্নামেন্ট অনবদ্য খেলেও তার দল আজ পরাজিত হয়েছে প্রবলতর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এর কিছুক্ষণ পরেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিলেন তিনি। মুখে তখনো হাসি নেই, চোখের শূন্য দৃষ্টি তখনও বিরাজমান। হাতের দু আঙুলে চিড় নিয়ে পুরো টুর্নামেন্ট খেলে সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব পেয়েও সোনার কাপ সেদিন ছুঁয়ে দেখা হয়নি সেই যুবকের।

হ্যাঁ, তিনি শচীন টেন্ডুলকার।

২০১৪ সালের ১৪ জুলাই। ফুটবলের পীঠস্থান ব্রাজিলেই সেই বছর আয়োজিত হচ্ছে ফুটবলের শ্রেষ্ঠ উৎসব; সেদিন রাতে ফাইনালে। রিও ডি জেনেইরোর সুসজ্জিত মারাকানা স্টেডিয়ামে শুরু হতে চলেছে বিশ্বকাপ ফাইনাল । কিছুদিন আগেই সেমিফাইনালে সাত গোল হজম করে ছিটকে গিয়েছে আয়োজক ব্রাজিল । সেই হারের বেদনায় হতাশায় তখনও শোকস্তব্ধ সমগ্র দেশ। ব্রাজিলকে উড়িয়ে দিয়ে আসা জার্মানদের সামনে এবার ব্রাজিলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা।

কেটে গেল দু-আড়াই ঘন্টা। বিশ্বকাপের আসরে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় স্বরূপ সোনার বল জিতলেন রোজারিওর বিষ্ময় বালক,ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পুরস্কারটি গ্রহণ করলেন তিনি। চোখে মুখে বেদনার ছাপ সুস্পষ্ট।  বিশ্বকাপের আসরে চার চারটি ম্যাচে সেরা খেলোয়াড় হয়েও  ফিনিশং লাইনটা পার করা হল না ম্যাজিশিয়ানের। দুর্ধর্ষ জার্মানদের বিরুদ্ধে তার দল যথাসাধ্য লড়াই করেছিল। কিন্তু সুযোগ নষ্টের খেসারত দিতে হল তা দলকে।

এবার আসা যাক অন্য এক ১৪ জুলাইয়ের ঘটনায়।

মারাকানার সেই রাতের ঠিক পাঁচ বছর পরের ঘটনা । স্থান লর্ডস ‍ক্রিকেট মাঠ। প্রথমবারের মত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইংল্যান্ড। নিজেদের দেশে  বিশ্বকাপ জিতে আনন্দে আত্মহারা ব্রিটিশ ক্রিকেটাররা। দর্শকরাও উচ্ছ্বসিত। সেই বিজয়োৎসব উপভোগ করছেন স্বয়ং ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীও। অদূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে এসব  দেখছেন ধীর স্থির শান্ত সৌম্যকান্তি সদাহাস্যময় কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন।

অদৃষ্টের এ কি নির্মম পরিহাস! স্কোরবোর্ড যদিও বলছে সুপার ওভারের পরও দুই দলের স্কোর সমান, কিন্তু  এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, এক বিতর্কিত নিয়মের জন্য তার দল আজ পরাজিত। তবুও কোনো ক্ষোভ, অভিযোগ, রাগ নেই। নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দলনায়ক, ঠোঁটের কোণে তখনও লেগে রয়েছে সেই পরিচিত হাসি। যদিও সে হাসিতে তখন এক বেদনার ছাপ স্পষ্ট। একটু পরেই  টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের সম্মান পেলেন তিনি। কিন্তু সোনার কাপটা ছুঁয়ে দেখা হল না।

এতোক্ষনে নিশ্চয়ই গল্পগুলোর মিলটা খুজে পেয়েছেন। টুর্নামেন্টে একক আধিপত্য দেখিয়েও, বিশ্বকে নিজের জাদুতে অবশ করেও অনেকের স্পর্শ করা হয় না কিছু মানুষের। কিছু মানুষ হয়ে ওঠেন কাছে গিয়ে না পাওয়ার বেদনার প্রতীক। এই রবার্তো ব্যাজিও, শচীন টেন্ডুলকার, লিওনেল মেসি এবং কেন উইলিয়ামসন পুড়েছেন এই একই আগুনে।

বিশ্বকাপ মানে কি?

এক কথায় বিশ্ব শ্রেষ্ঠ হওয়ার  জন্য কিছু দেশের লড়াই। কিন্তু শুধু কি তাই? কত জাতির কত সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে একমাস ব্যাপী বিশ্বকাপে। মানুষের ড্রয়িংরুম থেকে শুরু করে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের আড্ডায় ও চলতে থাকে নানা রকম আলোচনা, তর্ক বিতর্ক। এ যেন এক উৎসব; যাতে গা ভাসিয়ে দেয় বিশ্বের প্রতিটি কোণের মানুষ। কত ইতিহাস, কত স্মৃতি,কত লড়াই, কত সাফল্য ব্যর্থতার সাক্ষী এই বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপের মধ্যে দিয়েই কত তারকা মহাতারকাকে পেয়েছে ক্রীড়াজগত।

ইতিহাস চিরকালই বিজয়ীদের মনে রাখে। বিজয়ীদের সাফল্যের মাঝে হারিয়ে যায় অনেক লড়াই। অনেক স্বপ্নভঙ্গের গল্প। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে জোহানেসবার্গ, রিও থেকে লন্ডন পর্যন্ত ভেসে চলে একই গানের সুর।

অনেক সময়ে নিজের সেরাটা দিয়েও অনেকে তাদের দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারেননা। উপরোক্ত চারজন সেই সব মানুষদের মধ্যেই পড়েন। এদের মধ্যে  তিনজনই ছিলেন টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়; ব্যতিক্রম হলেন। যদিও দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় হিসেবে  জিতেছিলেন সিলভার বল । কিন্তু তবুও সোনার কাপটা স্পর্শ করতে পারেননি । শেষ মুহূর্তে হেরেও সেদিন তাঁদের চোখে জল ছিল না, মনে মনে ক্ষতবিক্ষত হলেও সেদিন সকলের সামনে তারা চোখের জল ফেলেননি।

হয়ত তাঁরা আফসোস করেছেন-পেনাল্টি কিকটা যদি একটু  আস্তে নিতেন বা ম্যাকগ্রার বলটা যদি ব্যাটের একটু মাঝে লাগত বা দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে নয়্যারকে পরাস্ত করে বলটা যদি সেকেন্ড পোস্টের ধারঘেঁষে বেরিয়ে না যেত বা ওভারথ্রো এ যদি চার রান না হত। ইতিহাস হয়তো তাহলে অন্য রকম ভাবে লেখা হত।

প্রাণান্তকর চেষ্টা করার পরেও যখন  সামনে পেয়েও যখন সেই দুর্লভ কাপকে ছুঁয়ে দেখা সম্ভব হয় না, সেরা খেলোয়াড় হয়েও যখন দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন শুনতে হয়। যখন সমস্ত টুর্নামেন্টের পারফরমেন্স ভুলে গিয়ে একটি ম্যাচের জন্য সারা জীবনের জন্য ‘ব্যর্থ’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়।

ইতিহাস হয়তো তাদের জয়ী হিসেবে মনে রাখবে না। মাঠের লড়াইয়ে তারা হেরে গিয়েছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন বলা যায় কি? তারা শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হয়েছেন কিন্তু বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হননি। হেরে গিয়েও প্রবল দুঃখ পেয়েও তারা হাসিমুখে সে হার মেনে নিয়েছেন। আবারও মাঠে নেমেছেন, শিখিয়েছেন লড়াই করে যাওয়ার মন্ত্র। শচীন টেন্ডুলকার যেমন ওই জ্বালা বুখে নিয়ে আট বছর ঘোরার পর সেই বিশ্বকাপ হাতে তুলেছেন।

এক ব্যর্থতা তাই মানুষের থেমে যাওয়ার গল্প হতে পারে না। মানুষ ওখান থেকেই ঘুরে দাড়ায়। মেসি ঘুরে দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বজয়ের আনন্দে ভাসিয়েছেন। কেন উইলিয়ামসন জিতেছেন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। নিয়তি এভাবেই ফিরিয়ে দিতে জানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link