আজকাল একটা যুক্তি খুব বেশি করে কানে আসে। বর্তমান বোর্ড প্রেসিডেন্ট ও প্রাক্তন অধিনায়ক, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি একটা দীর্ঘ সময় শুধু অধিনায়ক কোটার জোরে খেলে গেছেন। সেই মন্তব্যের সারবত্তা কিছুটা কৌতূহল বশত: হঠাৎ পরখ করে দেখতে মন চাইলো। কিছু পরিসংখ্যান এবং নিজের চোখে দেখা কিছু ব্যাপার নিচে দিলাম। বাকি মতামত পাঠক কুলের। আজকে দ্বিতীয় পর্ব। অর্থাৎ দেশের মাটিতে অধিনায়ক ও ব্যাটার সৌরভকে নিয়ে আলোচনা।
সৌরভ ভারতের মাটিতে ২১ টি টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন। সেই সব টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় নিতান্তই সাধারণ। মাত্র ২৯.৯৩। অধিনায়ক হিসাবে দেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে। দিল্লীতে। সৌরভ করেন যথাক্রমে ২৭ ও ৬৫ অপরাজিত। প্রথম ইনিংসে জিম্বাবুয়ের ৪২২ এর জবাবে ভারত যখন ৩৪৭ রানে ৩ উইকেট, তখন নামেন সৌরভ। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯০ তাড়া করতে নেমে ভারত যখন ৮০ রানে ৩ উইকেট, তখন সৌরভ নামেন। এবং করেন ম্যাচ জেতানো ৬৫। দ্বিতীয় টেস্টে সৌরভ করেন ৩০।
যখন নামেন তখন ভারতের স্কোর ৪৭৬। অর্থাৎ যখন রান করাটা স্রেফ নিয়মরক্ষার মতো, তখন সৌরভ বিশাল কিছু করতে পারেননি। কিন্তু যখনই ভারত নড়বড়ে, সৌরভ কিন্তু খেলে দিয়েছেন। অন্তত এই সিরিজে। পরের অস্ট্রেলিয়া সিরিজ অবশ্য সৌরভের জীবনের অন্যতম খারাপ সিরিজ। অধিনায়ক সৌরভের জন্য এই সিরিজ অমরত্বের বেদি তৈরি করে দেয়। কিন্তু ব্যাটার সৌরভ এই সিরিজে ঠিক ততটাই স্তিমিত। এবং এই সিরিজে খারাপ ব্যাটিংয়ের পর অনেকেই সৌরভকে অধিনায়কত্ব থেকে সরাতে চেয়েছিলেন।
সৌরভকে অধিনায়ক করা হচ্ছিল সিরিজ ধরে ধরে। অনেকটা সময়ের জন্য স্থায়ী ছিল না তাঁর পদ। নেহাত শ্রীলংকা সফরে ব্যাটে একটা ম্যাচ জেতানো ৯৮ ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ওয়ানডে সিরিজে অনবদ্য ইনিংস গুলো ছিল। না হলে সম্ভবত দ্রাবিড় ২০০৫ এর আগেই অধিনায়ক হয়ে যেতেন।
২০০২ এর শুরুতে এরপর ভারতে আসে ইংল্যান্ড। মোহালি টেস্টে ভারত ২১২ রানে ৩ উইকেট এই অবস্থায় নেমে সৌরভ করেন ৪৭। ভারত সেই ম্যাচ জেতে। হেসেখেলেই জেতে। বাকি দুই ম্যাচে অবশ্য সৌরভ খানিক ব্যর্থ। আমেদাবাদে ৫ ও ১৬ নট আউট। ব্যাঙ্গালোরে ০। ঠিক পরের সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে অবশ্য সৌরভ আবারও স্ব-মহিমায়। একটি সেঞ্চুরি করলেন। বাকি ২০০২ টা সৌরভের অসম্ভব ভালো যায়। অন্তত ঘরোয়া মৌনুম শুরু হওয়া অবধি।
২০০৩ বিশ্বকাপে সৌরভ অধিনায়ক হিসাবেই যাচ্ছেন, সেটা নিজের ব্যাট এবং ভারতের ফলাফল দিয়েই তিনি নিশ্চিত করেন। জগু ডালমিয়ার নীরব নিঃশর্ত সমর্থন অবশ্য এই সময় সৌরভ পান। ২০০২ এর ঘরোয়া মরসুমে সৌরভ এরপর সামনে পেলেন ওয়েস্টইন্ডিজ কে। প্রথম টেস্টে করেন ৪। ২৮১ রানে ৩ উইকেট অবস্থায় নামেন। দ্বিতীয় টেস্টে করেন ০। যদিও ভারত তখন ১৫৫ রানে ৩ উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৬৭র জবাবে। অর্থাৎ এখানেও আপাত চাপহীন।
ফুরফুরে। ইডেনে করেন ২৯ ও ১৬।প্রসঙ্গত এই টেস্টে শচীন দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করে ম্যাচ বাঁচিয়ে দেন।
২০০৩ বিশ্বকাপ পরবর্তী দেশের মাটিতে হওয়া টেস্ট সিরিজ গুলোয়, এক নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি সেঞ্চুরি ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৫৭ ছাড়া বলার মতো কিছুই নেই তাঁর। এই সময় তাঁর গড় ১২ ইনিংসে মাত্র ২৯.৯০। এবং একটি ১০০ অপরাজিত সত্ত্বেও। দুই অত্যন্ত জরুরি সিরিজে সৌরভের ব্যাট চুপ ছিল।
২০০৪ এর বর্ডার-গাভাস্কার ও ২০০৫ এর পাকিস্তান সিরিজ। দুটি সিরিজই ভারত জিততে ব্যর্থ হয়। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তো ৩৫ বছর পর দেশের মাটিতে (অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে) হারে ভারত। ঠিক এই সময় থেকেই অধিনায়ক সৌরভের পতন শুরু। ব্যাটার সৌরভেরও। যেসব সাংবাদিক যুক্তি দেন যে শেষ সিরিজে সেঞ্চুরি করার পরেও সৌরভকে অন্যায় ভাবে বাদ দেওয়া হয়, তা এই কারণেই অসার যে আগের জরুরি সিরিজ গুলোয় তিনি ক্রমাগত রান পাচ্ছিলেন না। এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তো দ্বিতীয় সারির বোলিং খেলতে গিয়ে নাকানি- চোবানি।
কিন্তু, অধিনায়কত্বের প্রথম দু বছরে দেশের মাটিতে ব্যাটার সৌরভ এতটাও খারাপ নন। বরং ২০০৪ এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৫ এর সেপ্টেম্বর, সৌরভ প্রায় অধিনায়ক হবার সুবাদেই খেলেন। এই সময় তাঁর ব্যাটিংয়ে গতি ছিল না। এমন এমন সব আউট হচ্ছিলেন যা চোখে দেখা যায় না। তুলনীয় একমাত্র ২০০১ এর বোর্ডার গাভাস্কার সিরিজ।
আজকের পর্ব শেষ করি এক বিখ্যাত সাংবাদিকের লেখা একটি ঘটনা দিয়ে। ২০০৫ এর পয়লা এপ্রিল। আর মাস চারেক বাদে বাঙালির চক্ষুশূল হতে চলা দ্রাবিড়, যুবরাজ ও হরভজন মিলে সৌরভকে এপ্রিল ফুল করেন। সোজা বাংলায় বললে ‘প্র্যাঙ্ক’। তাঁরা সৌরভকে গিয়ে বলেন, ‘তোমার অধিনায়কত্ব আর পোষাচ্ছে না হে। মানে মানে কাটো এবার।’
সৌরভ বিস্মিত। এরা বলে কি? সৌরভ যখন কাঁদো কাঁদো, দ্রাবিড় বলে ওঠেন, ‘এপ্রিল ফুল’। অর্থাৎ ফর্মহীন প্রবল চাপে থাকা অধিনায়কের মেজাজ ভালো করতে তাঁর দলের ছেলেরা এবং আপাত ভাবে অধিনায়কের গদির প্রবল দাবিদার এ ধরণের ছেলেমানুষি করছেন। ভারতীয় ক্রিকেটে আগে বা পরে হয়েছে কিনা জানি না। কাজেই সৌরভ ক্যাপ্টেন কোটায় খেলে যান বা না যান, তাঁর দল তাঁর প্রতি বিশ্বাস হারায়নি। তথ্য-পরিসংখ্যানের কচকচির শেষে নেতা সৌরভের বোধহয় এটাই সবচেয়ে বড় পাওনা।