‘সৌরভ’ বা ‘বিশ্বনাথ’ যেন ফিরে না আসে

তিন এপ্রিল, ২০১১। সকাল বেলা।

কিছুক্ষণ আগেই পার্টি শেষ করে টলমল পায়ে ভারতীয় বীরেরা যে যার ঘরে গেছেন। ততক্ষণে ভারতের বিভিন্ন কোণায় পৌঁছে গেছে সেদিনের দৈনিক পত্রিকা। বেশির ভাগ কাগজেই ধোনির কাপ হাতে ছবির পাশাপাশি কোথাও একটা স্থান করে নিয়েছিল আর একটা ছবি।

বিশ্বজয় শেষ, ধারাভাষ্যকার হিসেবে কিছু কাজের জন্য মাঠে ঢুকছেন সৌরভ গাঙ্গুলি, মুখে প্রতিফলিত হচ্ছে কয়েক হাজার ওয়াটের আলো আর তিনি তন্ময় হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দেখছেন আতস বাজির কারসাজি। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্তে এক নি:সঙ্গ সম্রাট; যিনি শত চেষ্টাতেও কাপ আর ঠোঁটের দূরত্ব ঘোচাতে পারেননি।

সেদিন তাঁর হাতে তৈরি তাঁর অতি বিশ্বস্ত কোন সৈনিক বা পরম বন্ধুও তাঁকে একবারের জন্যও ডেকে বলেননি যে এসে আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নাও এই স্মরণীয় মুহূর্ত, আজ যে গাছটা ফল দিয়েছে তাঁর বীজটা তো তোমার হাতেই পোঁতা। সময় বড় নির্মম। বুঝে নিয়েছিলেন মুকুটহীন সম্রাট। তুমি মুকুটহীন মানে উপেক্ষাই তোমার একমাত্র পুরস্কার।

এর আট বছর আগের কাপ ফাইনালের আগের দিন এক সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেছিলেন কাল দলের তরুণ খেলোয়াড়দের উত্তেজনা প্রশমিত করে রাখাটাই সৌরভের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি নাকি ’৯২ ফাইনালের আগের দিন রাতে সবাইকে একটা করে ঘুমের ট্যাবলেট দিয়েছিলেন অতিরিক্ত উত্তেজনা প্রশমিত করতে। কারণ ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুলে ঘুম আসতে বাধ্য আর জেগে থাকলে অতিরিক্ত উত্তেজনা বা অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের সম্ভাবনা বেশি।

কিন্তু, ইমরানের সুবিধে ছিল তাঁর ম্যাচটা ছিল দিন রাতের আর সৌরভের ক্ষেত্রে খেলা শুরু হয়েছিল সকাল নয়টায়। আর ঠিক ওই অতিরিক্ত অ্যাড্রিনালিনই জহিরের প্রথম ওভারে ১৫ রান উপহার দিয়ে ম্যাচের রাশ আলগা করে দেয়। অভিজ্ঞ এবং পরিণত জহির আট বছর পরে শিখে গেছেন কিভাবে অতিরিক্ত উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে হবে আর তার ফল স্বরূপ দলকে উপহার দিলেন তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা একটা স্পেল।

ম্যাচের রাশ হাতের বাইরে বেরলো না। কিন্তু এত কিছুর পরেও তিনি থেকে গেলেন আপাত ভাবে উপেক্ষিত। ২০১১ বিশ্বকাপ মানেই যুবরাজ, ফাইনাল মানেই গম্ভীর-ধোনি, এমনকি শাস্ত্রীর কমেন্ট্রিও কিন্তু ভীষন কম আলোচিত জহির এবং তাঁর প্রথম স্পেল, যেটা না থাকলে এবারেও হয়তো ৩৩০ তাড়া করতে হত।

পাঠকের মনে হতেই পারে কেন বললাম একথা! বিশ্বকাপ জয়ের দশ বছর পালন হল কয়েক ঘন্টা আগে। প্রচুর লেখা এবং ছবি। কেন্দ্রবিন্দুতে ধোনি, গম্ভীর, যুবরাজ এবং পতাকা হাতে ইউসুফদের কাঁধে শচীন। বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর জন্য বরাদ্দ হয়তো কোন গ্রূপ ছবি। নায়ক হয়েও উপেক্ষিত। হয়তো বোলার বলেই।

না। উপেক্ষিত নায়কদের মধ্যে সেরা পুরস্কার উপরের দুজনের মধ্যে কেউই পাচ্ছেন না। ওটা যাচ্ছে ব্যাঙ্গালুরুতে। প্রায় আটত্রিশ বছর আগে কপিল দেবের বিশ্বকাপ জয়ী দল সবে ভারতের মাটিতে পা রেখেছে। বিমানবন্দর উপচে পড়েছে বিশ্বকাপ জয়ী নায়কদের বরণ করতে। সারা দেশের সমস্ত ক্রীড়া সাংবাদিক চিত্র সংবাদিকরাও হাজির।

এক অত্যুৎসাহী চিত্র সাংবাদিক (বাংলার নয়) বিশ্বজয়ী নায়কদের ছবি নেওয়ার জন্য হিথরো থেকে আসা ওই একই বিমানের আর এক যাত্রীর ব্যাগ সহ ট্রলির উপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন আর হতভম্ব সেই যাত্রীটিও অপেক্ষা করতে থাকলেন সেই জনৈক চিত্র সংবাদিকের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত আর এই পুরো ছবিটা ক্যামেরা বন্দি করে আজকালের দপ্তরে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত চিত্র সংবাদিক।

যে যাত্রীর ট্রলির উপর দাঁড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে বিশ্বজয়ী নায়কদের ছবি সংগ্রহ করছিলেন ওই অর্বাচীন সাংবাদিক, সেই যাত্রীর ’৭৯ এর বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটা ঝকঝকে ৭৫ রান আছে, নাম গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। আর এক অপমানিত এবং উপেক্ষিত নায়ক বিশ্বকাপ সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে।

সৌরভ, বিশ্বনাথ, সক্রেটিস, জিকো, ফিগো, হেডলি, বেথামদের মত চরিত্রগুলো তথাকথিত সোনার মাধুরীর পরশ না পেয়ে হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে উপেক্ষার পাত্র হয়ে থেকে গেছেন, কিন্তু সেই উপেক্ষার অনেক অনেক উপরে বিরাজ করছে তাদের শৈলী, যেখানে অনেক কাপজয়ী খেলোয়াড়ও পৌঁছতে পারবে না। দুবছর বাদে আবার ২৫ জুন বা ২ এপ্রিল ফিরে আসুক, কিন্তু আর একটা ‘সৌরভ’ বা ‘বিশ্বনাথ’ যেন ফিরে না আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link