Social Media

Light
Dark

‍দুর্নিবার গতি, দুর্বিনীত কণ্ঠস্বর

মায়ের দেশ বলেই হয়তো জিম্বাবুয়ের প্রতি এক অদ্ভুত ভালবাসা কাজ করতো তাঁর। ফলে কিশোর বয়সেই দেশটির নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলবেন বলে। ক্রিকেট ও দেশ দুটিকেই নিজের অন্তরে লালন করতেন জিম্বাবুয়ের প্রথম এই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার। তবে একসময় এই দেশ ও ক্রিকেটের প্রতি এই ভালবাসার কারণেই দেশ ছাড়তে হয়েছিল হেনরি ওলোঙ্গাকে।

বাবা ছিলেন কেনিয়ার নাগরিক হলেও ওলোঙ্গার মাতুতালয় ছিল জিম্বাবুয়েতে। তাঁর পড়াশোনা বেড়ে ওঠাও হয়ছে জিম্বাবুয়েতেই। ছোটবেলা থেকে নানারকম খেলাধুলার সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে গান ও অভিনয়েও দারুণ পারদর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর এক ভাই আবার জিম্বাবুয়ে রাগবি দলের অধিনায়কও ছিলেন। ফলে ভাইয়ের সাথে রাগবিও নিয়মিতই খেলতেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটই হয়েছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। সেই ক্রিকেটের জন্যই এক সময় জীবনের হুমকিতে পড়তে হয় ওলোঙ্গাকে।

স্কুল জীবন থেকেই নিজের ক্রিকেট প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে আসছিলেন এই পেসার। ১৯৯৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন। তারপর জাতীয় দলের নজরে আসতে খুব বেশি সময় নেননি। পরের বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের জন্যই দলে ডাকা হয়েছিল ওলোঙ্গাকে। তবে তখনো জিম্বাবুয়ের নাগরিকত্ব নিয়ে জটিলতা শেষ হয়নি। ফলে পরের সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে হারারেতে টেস্ট অভিষেক হয় তাঁর।

সেই সময়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই জিম্বাবুয়ের সবচেয়ে গতিময় বোলার ছিলেন ওলোঙ্গা। তবে লাইন-লেন্থ নিয়ে কিশোর বয়সে বেশ ভালোই ভুগছিলেন এই পেসার। ওয়াইড ও নো বলের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তবে সবচেয়ে বড় বাঁধা আসলো বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর। অনেকেই ভেবেছিল ফিরে আসলেও এই পেস হয়তো আর থাকবে না তাঁর বোলিং এ। তবে সবাইকে ভুল প্রমাণ করে নিজের চেনা রূপেই ফিরে এসেছিলেন এই পেসার। বরং লাইন লেন্থে এবার ছিলেন আরো পরিণত।

আসলে ওলোঙ্গার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল তাঁর সততা ও ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে একাদশে সুযোগ পেয়েও টিম মানেজম্যান্টকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে না রাখার জন্য। কেননা তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁর প্রস্তুতিতেই কিছুটা ঘাটতি আছে।

জিম্বাবুয়ের ওই জার্সি গাঁয়ে মাঠে নামার জন্য তাঁর আরেকটু প্রস্তুত হয়ে আসা দরকার। তিনি যে সেটা মন থেকে বলেছিলেন তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী সময়ে তাঁর পারফর্মেন্স দেখলেই। ২০০৩ সালে তিনি যখন তাঁর ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে তখনো জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে লড়ে আরেকবার প্রমাণ দিয়েছিলেন ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালবাসার।

১৯৯৮ সালে ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয় পায় জিম্বাবুয়ে। রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলিদের সেই ভারতকে হারানোর নায়ক ছিলেন ওলোঙ্গাই। প্রথম ইনিংসে তাঁর বোলিং ঝড়েই মাত্র ২৮০ রানে অল আউট হয়ে গিয়েছিল ভারত। দ্বিতীয় ইনিংসেও তাঁর দ্বিতীয় ওভারেই উইকেট তুলে নিয়ে জিম্বাবুয়েকে জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন তিনি।

সেই বছরেই ঘরের বাইরে প্রথম টেস্ট জ্বয়ের স্বাদ পায় দেশটি। পাকিস্তানের বিপক্ষে পেশওয়ারে সাত উইকেটের সহজ জয় পেয়েছিল তাঁরা। এবার পাকিস্তান ব্যাটিং লাইন আপের সবচেয়ে বড় হুমকি ছিলেন ওলোঙ্গাই। প্রথম ইনিংসে পাকিস্তান ৫৮ রানের লিড পেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১০৩ রানেই গুটিয়ে যায় তাঁরা। সাঈদ আনোয়ার, ইজাজ আহমেদ, ইনজামামুল হকদের সেই ব্যাটিং লাইন আপ গুঁড়িয়ে দিয়ে ৭৮ রানেই ৪ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন হেনরি ওলোঙ্গা।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে প্রতুত ওলোঙ্গা ঠিকই মাঠে নেমেছিলেন ভারতের বিপক্ষে। জিম্বাবুয়ের দেয়া ২৫৩ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে জয়ের পথেই এগিয়ে যাচ্ছিল ভারত। শেষ তিন ওভারে ভারতের প্রয়োজন মাত্র সাত রান। সেই সময় বোলিং এ আসলেন ওলোঙ্গা। সেই ওভারেই তিন তিনটি উইকেট নিয়ে ভারতের সহজ জয় কেড়ে এনেছিলেন ওলোঙ্গা।

সব মিলিয়ে তখন জিম্বাবুয়ের পেস বোলিং অ্যাটাকের এক ভয়ানক নাম হেনরি ওলোঙ্গা। এরমধ্যে ২০০১ সালে সেই সময়কার জিম্বাবুয়ে প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের বিপক্ষে ক্রিকেটের জন্য লড়াই করলেন ওলোঙ্গা। ২০০১ সালে মুগাবে ক্রিকেট দলে একটি কোটা পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। নূন্যতম কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারকে কোটার জন্য একাদশে রাখতেই হবে।

ক্রিকেটীয় চেতনাকে হুমকির মধ্যে ফেলা এই নিয়মের বিপক্ষে প্রতিবাদ করা্র সিদ্ধান্ত নিলেন অধিনায়ক অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। তিনি প্রথমেই গেলেন তাঁর দলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার ওলোঙ্গার কাছে। তিনি নিজে একজন কৃষ্ণাঙ্গ হলেও ওলোঙ্গা জানতেন আর যাই হোক বৈষম্য করে ক্রিকেট খেলাটা হয় না। এখানে খেলতে হলে নিজের যোগ্যতা দিয়েই খেলতে হবে।

ফলে দেশটির প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে আওয়াজ তোলার দুঃসাহস দেখালেন তিনি। ফলে তাঁরা দুজনে ঠিক করলেন ২০০৩ বিশ্বকাপে তাঁরা কালো আর্ম ব্যান্ড পরে মাঠে নামবে্ন এর প্রতিবাদ করার জন্য। তাঁরা বিশ্বকাপের আগে এই বিষয়ে বলেন, ‘আমরা বিশ্বকাপে কালো ব্যান্ড পরে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কারণ আমরা মনে করি জিম্বাবুয়ের গনতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে। আমরা সেজন্য শোকাহত। আমরা চাই না জিম্বাবুয়েতে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ হোক। তাই মাঠে এর মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানাব।’

দেশের প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে তাঁদের এই  প্রতিবাদ পুরো ক্রিকেট ইতিহাসেই সবচেয়ে দুঃসাহসিক ছিল। এর ফলও ভোগ করতে হয়েছে ওলোঙ্গাকে। বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়েই মুগাবে সরকারের অনেক উপরমহল থেকে হুমকি আসতে থাকে। ওলোঙ্গাকে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হতে থাকে। ফলে বিশ্বকাপ শেষ করে অসাধারণ এক ক্যারিয়ার ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান ওলোঙ্গা। লন্ডনে গিয়ে তিনি আবার তাঁর সংগীত চর্চায় মনোযোগ দেন।

মাত্র ২৬ বছরে ক্রিকেট ক্যারিয়ার থেমে গেলেও ওলোঙ্গার ঝুলিতে ছিল ৬৮ টি টেস্ট ও ৫৮ টি ওয়ানডে উইকেট। এই সংখ্যা গুলো হয়তো আরো কয়েকগুন হতে পারতো তিনি ক্রিকেটের জন্য এই আত্মত্যাগ না করলে। একটা অপশক্তির বিপক্ষে লড়াই করে ওলোঙ্গার মহাতারকা হওয়ার যাত্রাটা হয়তো থেমে গিয়েছিল তবে তিনি এক আলোকিত সড়ক তৈরি করে গিয়েছিলেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তিনি গোটা বিশ্বকে জানিয়ে গিয়েছিলেন সবার উপরে ক্রিকেট সত্য, তাহার উপরে নাই।

 

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link