আর মাত্র একটি ম্যাচ, এরপরেই জানা যাবে কে হতে যাচ্ছে ফুটবল বিশ্বের নতুন চ্যাম্পিয়ন। তাই সারা বিশ্বের দর্শক-সমর্থকদের চোখ এখন কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। দুই ফাইনালিস্ট আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সের শক্তিমত্তা আর সম্ভাব্য কৌশল এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে ফুটবল বোদ্ধাদের আলোচনার বিষয়।
বিশ্বকাপ শুরুর পূর্বে ইনজুরিতে কারণে ফ্রান্সের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার ছিটকে যান মাঠ থেকে। পল পগবা, এনগোলো কান্তে, প্রেসনেল কিম্বেপে, এনকুনকু এবং করিম বেনজেমার মতো তারকা খেলোয়াড়দের হারিয়ে টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল ফ্রান্স। তবে কোচ দিদিয়ের দেশ্যমের বিচক্ষণতা এবং স্কোয়াডের বাকিদের দারুণ পারফরম্যান্সের সাহায্যে বাজিমাত করেছে ফ্রান্স। একাদশে প্রথম পছন্দদের কয়েকজন ফুটবলারকে ছাড়াই দ্বিতীয়বারের মত আসরের ফাইনাল নিশ্চিত করেছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা।
অন্যদিকে উদ্বোধনী ম্যাচে হোঁচট খাওয়ার ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। সৌদি আরবের বিপক্ষে সেই অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর নতুন করে গুছিয়ে উঠেছে দলটি। একে একে সব বাধা অতিক্রম করে ২০১৪ সালের পর আরো একবার শিরোপার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে আলবিসেলেস্তারা। লিওনেল মেসির আরাধ্য স্বপ্ন পূরণ এবং আর্জেন্টাইন ভক্তদের সুদীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটাতে আর মাত্র এক ম্যাচ দূরে দাঁড়িয়ে আছে তাঁরা।
দুর্দান্ত ছন্দে থাকলেও প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখছে না কোন দলই। দুই দল-ই প্রতিপক্ষকে সম্মানের চোখে দেখেই সাজাচ্ছে নিজেদের পরিকল্পনা। ইনজুরি আর কার্ড নিষেধাজ্ঞার সমস্যা কাটিয়ে আর্জেন্টিনা শিবির এখন অনেকটাই নির্ভার; শুরু থেকে মাঠে নামার জন্য ফিট হয়ে উঠেছেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। তবে পায়ের অ্যাঙ্গেলে চোট পাওয়া আলেজান্দ্রো গোমেজকে এখনো নিয়ে শঙ্কা কাটেনি।
অন্যদিকে ঠান্ডাজনিত সমস্যায় দলের বেশ কয়েকজনকে নিয়েই দুশ্চিন্তায় ফরাসি ম্যানেজম্যান্ট। বিশেষ করে ডিফেন্ডার দায়োদ উপামেকানো ও আদ্রিয়েন রাবিয়টের শরীরে ঠান্ডা ভাইরাসের উপসর্গ রয়েছে। সেমিফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে ম্যাচটিতে তাই খেলা হয়নি ফ্রান্সের এই দুই ফুটবলারের। এছাড়া তরুণ উইঙ্গার কিংসলে কোমানের শরীরেও জ্বর অনুভূত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। যদিও ফরাসি কোচ আশা করছেন ফাইনালের আগে পূর্ণ শক্তির স্কোয়াডই পাবেন।
অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া ফিরলে আর্জেন্টিনা তাদের স্বভাবসুলভ ৪-৩-১-২ ছকেই দল সাজাবে। গোলবারের সামনে ইমি মার্টিনেজের উপস্থিতি নিশ্চিতই বটে, রক্ষণভাগে জুটি গড়বেন অভিজ্ঞতা ওতামেন্ডি এবং তরুণ ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো। রাইটব্যাকে নাহুয়েল মলিনা এর পাশাপাশি লেফটব্যাক পজিশনে ফিরবেন মার্কোস অ্যাকুনা।
তিন জনের মিডফিল্ডে ম্যাক অ্যালিস্টার এবং ডি পলের সুযোগ পাওয়া প্রায় নিশ্চিত। এছাড়া লিসান্দ্রো প্যারাদেস এবং এঞ্জো ফার্নান্দেসের মাঝে একজন সুযোগ পেতে পারেন। প্লে-মেকার পজিশনে দেখা যাবে লিওনেল মেসিকে এবং তাঁর দুই পাশে উইঙ্গারের ভূমিকায় দেখা যাবে জুলিয়ান আলভারেজ এবং ডি মারিয়াকে।
তবে কিলিয়ান এমবাপ্পে, গ্রিজম্যানদের থামানোর জন্য ত্রি-ম্যান ব্যাকলাইন নিয়ে নামতে পারে লিওনেল স্কালোনির শিষ্যরা; একজন মিডফিল্ডারের জায়গায় দেখা যেতে পারে লিসান্দ্রো মার্টিনেজকে। সেক্ষেত্রে ৩-৪-১-২ ফর্মেশনে খেলবে টিম আর্জেন্টিনা। দুই ফুলব্যাক খেলবেন ওয়াইড মিডফিল্ডার হিসেবে। অবশ্য অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া শুরুর একাদশে না ফিরলে কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়নদের লাইনআপ।
বরাবরের মতই হয়তো পছন্দের ৪-২-৩-১ ছকে সাজাবেন দিদিয়ের দেশম। ফুলব্যাক জুলস কুন্দে এবং থিও হার্নান্দেজের পাশাপাশি রক্ষণের দায়িত্বে থাকবেন সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকা রাফায়েল ভারানে। বাকি একজন হতে পারেন ইব্রাহিমা কোনাতে অথবা দায়োদ উপামেকানো। এছাড়া আর্জেন্টিনার শক্তিশালী আক্রমণগুলোকে অগোছালো করে দেয়ার দায়িত্ব থাকবে অরেলিয়েন চুয়ামেনির কাঁধে।
ইনজুরি থেকে ফিরে আসতে পারলে আদ্রিয়েন র্যাবিয়েটকে দেখা যাবে ফাইনাল ম্যাচে। তা না হলে তরুণ ইউসুফ ফোফানার উপর ভরসা করতে হবে ফরাসিদের। লেফট এবং রাইট মিডফিল্ডার যথাক্রমে কিলিয়ান এমবাপ্পে এবং উসমান ডেম্বেলের খেলা নিশ্চিত; এই দুইজনই আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগে গতির ঝড় তুলবেন তা বলাই যায়। নাম্বার টেন পজিশনে সুযোগ তৈরি করার কাজটা করবেন আঁতোয়ান গ্রিজম্যান, আর সেসব সুযোগ কাজে লাগানোর অপেক্ষায় থাকবেন স্ট্রাইকার অলিভার জিরুদ।
ফ্রান্স আর্জেন্টিনার ম্যাচে ছোটখাটো অনেক দ্বৈরথ ম্যাচের ফলাফলকে প্রভাবিত করবে। বিশেষ করে কিলিয়ান এমবাপ্পে এবং লিওনেল মেসির মাঝে যিনি বেশি উজ্জ্বল থাকবেন মহারণে তাঁর দল নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে থাকবে। এছাড়া মিডফিল্ডে শুয়েমেনি, অ্যালিস্টার এর দ্বন্দ কিংবা রক্ষণে ওতামেন্ডি, ভারানের পারফরম্যান্স গড়ে দিতে পারে দুইদলের ভাগ্য।
বহুল আরাধ্য এই ফাইনালে এক্স ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে আর্জেন্টাইন তরুণ জুলিয়ান আলভারেজ। ইতোমধ্যে চার গোল করা এই সিটি ফুটবলারের কাছে আরো একবার দারুণ কিছু প্রত্যাশা করে ভক্তরা। আবার এমবাপ্পেকে ব্যস্ত আর্জেন্টাইন রক্ষণের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারেন উসমান ডেম্বেলে। আর একবার বল নিয়ে এগিয়ে গেলে এই উইঙ্গারকে পুনরায় নাগাল পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
আবার অভিজ্ঞ অলিভার জিরুড কিংবা অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া দেখাতে পারেন চমক। এবারের বিশ্বকাপ আসরে দারুণ ছন্দে আছেন জিরুদ, আর ফাইনাল মানেই তো ডি মারিয়ার ঝলক। তাই এদের উপর থেকেও চোখ সরানো যাবে না মুহুর্তের জন্য। এছাড়া হুগো লরিস এবং ইমি মার্টিনেজের গ্লাভসের পরীক্ষাও হবে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে।
অনেক কিছু হতে পারে, অনেক কিছু হবে। শেষ বাঁশি বেজে উঠলে কারো মন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে আর কেউবা মেতে উঠবে বাঁধনহারা উল্লাসে। লিওনেল মেসির আন্তর্জাতিক ম্যাচের রঙিন হবে নাকি পেলের পর সবচেয়ে কম বয়সী ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ জিতবেন কিলিয়ান এমবাপ্পে – উত্তরটা সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই, রোমাঞ্চ আর অঘটনে ভরা এই বিশ্বকাপে সব হিসেব-নিকেশ যে বড্ড অযৌক্তিক।