এখনও তাঁর শরীরে বিদ্যুৎ চমকায়। এখনও তিনি যেন সদা-বর্তমান।
সত্যিকারের অলরাউন্ডার বলতে যা বোঝায়, তিনি তাই। উইকেটের সামনে দাড়ালে তিনি ৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটসম্যান; যে কোনো জায়গায় বলকে পাঠাতে পারেন। আবার ২৯৭ বলে ৪৩ রানের দেয়ালসূলভ ইনিংস খেলতে পারেন তিনি। উইকেটের পেছনে তিনি দারুণ উইকেটরক্ষক। আউটফিল্ডে তিনি সেরা ফিল্ডার। বল হাতে কার্যকর বোলার।
তিনি একজন পূর্নাঙ্গ ক্রিকেটার, একজন রাগবি খেলোয়াড়, একজন গলফার, একজন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়; তিনি আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্স। হ্যাঁ, এবি ডি ভিলিয়ার্স।
দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়ার্মবাডে জন্ম ডি ভিলিয়ার্সের। বাবা ছিলেন রাগবি ইউনিয়ন খেলোয়াড়। তার উৎসাহেই রাগবি শুরু করেছিলেন। কিন্তু স্কুলে গিয়ে আরেকটা ভালোবাসা আবিষ্কার করলেন। তার স্কুল বন্ধুদের একজন ছিলেন ফাফ ডু প্লেসিস। আর এই বন্ধুদের সাথে শুরু করলেন ক্রিকেট খেলা। কালক্রমে সেই ক্রিকেটই হয়ে উঠলো তাঁর প্রধান পরিচয়।
শুরুটা হয়েছিলো অনূর্ধ্ব ১৯ দলে। তখন ছিলেন নিখাঁদ ওপেনার; সাথে উইকেট কিপিং করতেন। খুব দ্রুতই জাতীয় দলে চলে এলেন। ২০০৪ সালে টেস্ট অভিষেক হলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। দ্বিতীয় টেস্টে ফিফটি পেলেও শুরুটা খুব ভালো ছিলো না। তবে পরের বছর ওই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই সেঞ্চুরিয়ন ও কেপ টাউনে রানের বন্যা বইয়ে দিলেন। এই শুরু হলো ডি ভিলিয়ার্সের রাজত্ব।
ওয়ানডেতে ক্যারিয়ার শুরু করার পর দুনিয়া চিনলো একেবারে নতুন এক আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের ব্র্যান্ডকে। উদ্ভাবনী শটের দিক থেকে ডি ভিলিয়ার্স দুনিয়াকে যা যা দেখালেন, তা এর আগে আসলেই কখনো দেখা যায়নি। তিনি বলের মেরিট অনুযায়ী বা ফিল্ডিং সেটআপ অনুযায়ী শট করেন না। তিনি শট করেন তার সুবিধে মতো। আপনি অফস্ট্যাম্পের বাইরে বল করলে তিনি শাফল করে গিয়ে সেটাকে লেগ সাইড দিয়ে ছক্কা মারবেন। প্রয়োজনে শুয়ে পড়ে ব্যাট চালাবেন।
উইকেটের যে কোনো জায়গায়, যে কোনো লেন্থে আপনি বল ফেলতে পারেন; ডি ভিলিয়ার্স তাতে শট করে চার-ছয় মারতে পারবেনই। উইকেটের চারপাশে বিচিত্র এইসব শট খেলতে পারার কারণে লোকে তাকে ‘থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি ব্যাটসম্যান’ বলতে শুরু করলো। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আসার পর ডি ভিলিয়ার্সের এসব শট আরও বেশী দেখা যেতে থাকলো।
ওয়ানডেতে যাবতীয় দ্রুততম স্কোরের রেকর্ড নিজের করে ফেললেন। দ্রুততম ফিফটি, সেঞ্চুরি ও ১৫০ রানের মালিক হলেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার দ্রুততম টি–টোয়েন্টি ফিফটির মালিকও তিনি। তবে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির এই পারফরম্যান্স দিয়েই আপনি ডি ভিলিয়ার্সকে একদমই চিনতে পারবেন না; একদমই না।
সেই চেনার জন্য আপনি বরং তার টেস্ট ইতিহাস একটু ঘেটে দেখতে পারেন। ২০০৮ সালে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে ভারতের মাটিতে ডাবল সেঞ্চুরি করেন। এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ২৭৮ রানের ইনিংসও খেলেছেন; যেটা দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংস। তবে মজাটা এখানেও নয়।
মজাটা হলো যে ব্যাটসম্যান, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দুনিয়ার সবচেয়ে অশান্ত, তিনিই টেস্টে কখনো কখনো হয়ে ওঠেন চেতেশ্বর পূজারার মতো অভেদ্য দেয়াল। টেস্টে তার এমন অনেক দিন এসেছে, যখন তিনি বলের পর বল খেলেছেন, কিন্তু রানের কথা মনেও আনেননি।
ভারতের বিপক্ষে দিল্লিতে তার সেই ২৯৭ বলে ৪৩ রানের ইনিংস তো কিংবদন্তি হয়ে আছে। ৩৫৪ মিনিট ব্যাট করেছিলেন এই ৪৩ রান করতে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাডিলেডে ২২০ বলে ৩৩ রান করেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১১৩ বলে ২০ রান করেছিলেন।
কেবল একটা পরিসংখ্যান বলি; ১৯-এর কম স্ট্রাইক রেটে টেস্টে ১৫টি ইনিংস খেলেছেন এই এবি ডি ভিলিয়ার্স। তারই আবার ওয়ানডেতে ১৬টি ইনিংস আছে ১৫০-এর ওপরে স্ট্রাইক রেটের; ৫টিতে স্ট্রাইক রেট ২০০-এর বেশী। টি-টোয়েন্টিতে ৮টি বড় ইনিংস আছে ২০০-এর ওপরে স্ট্রাইক রেটের।
এই লোককে আপনি কী বিশেষনে আটকাবেন!
একটা সময় মোটামুটি উইকেটকিপিং করতেন। মার্ক বাউচার খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর অধিনায়কত্ব পেলেন এবং ২০১৫ সাল পর্যন্ত টানা উইকেটরক্ষন করে গেছেন। কুইন্টন ডি ককের কাছে গ্লাভস ছেড়ে দেওয়ার পর মাঝে মাঝেই বল করতেন। টেস্টে ২০৪ ও ওয়ানডেতে ১৯২ ডেলিভারি করেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংস তাঁর। দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে আইসিসি টেস্ট র্যাংকিংয়ে সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া ক্রিকেটার তিনি। ক্যারিয়ারে ৫০.৬৬ গড়ে ৮ হাজার ৭৬৫ টেস্ট রান, ৫৩.৫০ গড়ে ৯ হাজার ৫৭৭ ওয়ানডে রান এবং ২৬.১২ গড়ে ১ হাজার ৬৭২ টি-টোয়েন্টি রান করেছেন।
২০১৫-১৬ সালেও ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে ছিলেন। ভালো অবস্থাতে থেকেই ২০১৮ সালে সব ধরণের ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন। ২০১৯ বিশ্বকাপে তার অবসর ভেঙে ফিরে আসা নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন তৈরি হলেও তা আর হয়নি। খেলেছেন গত আইপিএলেও।
তিন বার আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটার হয়েছেন। উইজডেনের দশকসেরা ক্রিকেটারদের একজন ছিলেন। এই জীবনে প্রাপ্তি তার কম নয়। তবে এখন স্রেফ ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুশী আছেন।
ক্রিকেটের বাইরে থেকেই সুখী আছেন এখন ডি ভিলিয়ার্স। এই যে সবসময় ক্যামেরার শব্দ, ফোকাসে থাকা; এর বাইরে থাকতে পেরে খুবই খুশী এই মারকুটে ব্যাটসম্যান। অবসরের পর বলছিলেন, ‘আমি সবসময় স্পটলাইটের বাইরে থাকতে পছন্দ করি। সবসময় আমি মানুষ হিসেবে এরকমই। যখন প্রোটিয়া দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হলাম, তখন একটু ব্যাপারটা বদলে গেলো। নইলে আমি খেলার বাইরে সবসময় এরকম নিজের জগতে থাকতে পছন্দ করি। এই জীবনই আমি সবচেয়ে বেশী উপভোগ করি।’
ডি ভিলিয়ার্স বলছিলেন, তিনি খেলাটা উপভোগ করেন এবং খেলার ভক্তদেরও পছন্দ করেন। কিন্তু লাজুক লোক বলেই তার সমস্যা হয়, ‘আমি সবসময় একটু লাজুক। আমি সত্যিই লোকেদের মনোযোগ কাড়তে চাই না বেশি একটা। এটা খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার। আমি একই সাথে এটা উপভোগ করি আবার বিব্রতও হই।’
তাহলে আমরা ডি ভিলিয়ার্সকে বিব্রত না করি। তিনি তার মতো থাকুন। আমরা স্রেফ তাঁর ফেলে যাওয়া খেলা উপভোগ করি।