এক হঠাৎ রাজার গল্প

রাজার একটা স্বপ্নপূরণ হয়েছে। তিনি জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে চলে এসেছেন। কিন্তু তার এক ঘনিষ্ঠজন বলছিলেন, এতে রাজার লক্ষ্য পূরণ হয়নি। কারণ, এই ছেলেটির স্বপ্ন নাকি একটু অন্যরকম। সে কেবল জাতীয় দলে খেলেই সন্তুষ্ট হতে চায় না। জাতীয় দলের হয়ে কিছু অর্জন করতে চায়, নিজেকে আর্ন্তজাতিক মানে নিয়ে যেতে চায়।

ছেলেটা মহা দুষ্টু।

আর সবাই যখন পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে, ছেলেটা তখন টেপ টেনিসেই গতির ঝড় তোলে। আর সবাই যখন বাসায় শান্ত হয়ে থাকে, তখন সে এসে বায়না করে-ক্রিকেট খেলতে ঢাকায় যাবো।

বাংলাদেশের প্রায় সব ক্রিকেটারেরই উত্থানের গল্পটা এরকম। তবে একটু পার্থক্য হলো, বাকীদের কারো বায়নায় কাবু হয়ে ছেলেকে একেবারে সত্যিই ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়ার কথা খুব একটা শোনা যায় না। কিন্তু সিলেটের এই বাবা-মা শেষ পর্যন্ত হার মানলেন ছেলের কাছে।

বড় ভাই তাকে নিয়ে এসে উঠলেন ঢাকায় এক মেসে। ব্যবস্থা হল সিটি ক্লাবে খেলার। বড় ভাই শুধু বললেন, ‘সবার মান রাখিস।’

শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা সময় বলবে। তবে আপাতত তিনি মান রেখেছেন। বাংলাদেশ টেস্ট দলে ডাক পেয়ে গেছেন রেজাউর রহমান রাজা। একবারের জন্য হলেই হয়ে উঠেছেন সত্যিকারের রাজা।

রাজার জন্ম সিলেটের ওসমানীনগর থানায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজার। সেখানেই পাড়ায় পাড়ায় টেপ টেনিস খেলে ক্রিকেটে হাতে খড়ি। তখন বোলিংয়ের পাশাপাশি ওপর দিকে ব্যাটও করতেন। এর মধ্যে উপজেলায় এক ক্রিকেট বলের টুর্নামেন্টে নাম লিখিয়ে ফেললেন। আর সেখানে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ ফাস্ট বোলার হিসেবে আবিষ্কার করলেন রাজা।

তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন বলছিলেন, এই টুর্নামেন্টের পরই রাজা ঢাকা যাওয়ার প্রতীজ্ঞা নিয়ে ফেলেছিলেন।

এর মাঝে সিলেটের একটা অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হলেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন, তার বোলিংয়ের নাড়ি ঢাকাতেই পোতা আছে। তাই জেদ করে, কান্না করে বাসার সবাইকে রাজী করালেন। বড় ভাইকে নিয়ে এলেন ঢাকায়। সিটি ক্লাবে খেলার ও অনুশীলন করার একটা ব্যবস্থা হলো।

এর মধ্যে খবর পেলেন, গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স একটা ট্যালেন্ট হান্ট করছে। সেখানে নাম লেখালেন রাজা। আর ওখানেই দেশের অন্যতম শীর্ষ কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের নজরে পড়ে গেলেন। আর সেখান থেকেই রাজার কেবল এগিয়ে চলার গল্প।

কিছুদিনের মধ্যে, ২০১৯ সালে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলা শুরু করলেন। ওই বছরই সিলেটের মধ্যে জাতীয় লিগে খেলার ভেতর দিয়ে অভিষেক হলো প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে।

শেখ জামালের হয়ে একদিনের ম্যাচ খেলেছেন মাত্র তিনটি; উইকেট তাতে ছয়টি। সর্বশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ হয়েছিলো টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। আর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে খেলেছিলেন মিনিস্টার রাজশাহীর হয়ে। মোট ১৬টি টি-টোয়েন্টিতে তার উইকেট আছে ১৫টি।

তবে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন সিলেটের ফাস্ট বোলার রাজা। সর্বশেষ ৩টি প্রথম শ্রেনীর ম্যাচে তিনি একবার ৫ উইকেটসহ ১২ উইকেট তুলে নিয়েছেন। ২০১৯ সালে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করা রাজা ১০টি ম্যাচে ৩৩ উইকেট নিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে আসলেই চিনিয়েছেন।

আর এই দূরন্ত পারফরম্যান্সই তাকে জাতীয় দলে নিয়ে এসেছে।

রাজাকে দলে নেওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রধাণ নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছেন, ‘তাসকিন ও শরিফুলের ইনজুরি নিয়ে চিন্তা থাকায় আমাদের পেস বোলিং অপশনকে আরও বেশি উন্মুক্ত রাখার দরকার ছিলো। সে জন্য আমরা রাজাকে ডেকেছি। আমরা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় তার পারফরম্যান্স নজরে রাখছিলাম। সে খুবই শক্তিশালী এবং এনার্জিটিক ছেলে। তার উইকেট নেওয়ার দারুণ একটা প্রবণতা আছে।’

রাজার এই আগমনের ভেতর দিয়ে সিলেটের পেস বোলিং ইউনিট আরও খ্যাতনামা হয়ে উঠলো। জাতীয় দলে সাম্প্রতিক খেলা চার পেসারেই এলেন সিলেট থেকে-খালেদ হোসেন, এবাদত হোসেন, আবু জায়েদ রাহি এবং রেজাউর রহমান রাজা।

সিলেটের এক পেসার বলছিলেন, ‘এটা একটা উত্তরাধিকারের মত ব্যাপার। একবার সিলেটের পেসাররা লংগার ভার্শন ক্রিকেটে ভালো করা শুরু করেছে। ফলে এদের দেখে আরও তরুনরা উঠে আসছে। এরা ভালো করলে রাজার মত আরও ছেলে উঠে আসবে।’

রাজার একটা স্বপ্নপূরণ হয়েছে। তিনি জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে চলে এসেছেন। কিন্তু তার এক ঘনিষ্ঠজন বলছিলেন, এতে রাজার লক্ষ্য পূরণ হয়নি। কারণ, এই ছেলেটির স্বপ্ন নাকি একটু অন্যরকম। সে কেবল জাতীয় দলে খেলেই সন্তুষ্ট হতে চায় না। জাতীয় দলের হয়ে কিছু অর্জন করতে চায়, নিজেকে আর্ন্তজাতিক মানে নিয়ে যেতে চায়।

তাই হোক।

রাজার এই স্বপ্নটা সত্যি হলে দেশেরই লাভ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...