নামটা লিখে রাখো

পরিসংখ্যান অন্তত বলে বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। কেবল রান করাতেই সেরা নন তিনি; উদযাপনেও তার শ্রেষ্ঠত্ব না মেনে উপায় নেই।

বাইশ গজে এই ড্যাশিং ওপেনার থাকা মানেই ডান্সিং ডাউন দ্য উইকেটে এসে বোলারকে সীমানার ওপারে আঁচড়ে ফেলা। তামিম মানে যেকোনো কন্ডিশনে,যেকোনো বোলারের চোখে চোখ রেখে লড়ে যাওয়া। তামিম মানে নিন্দুকের সব বাঁকা কথার ব্যাট হাতে সহজ জবাব এবং খ্যাপাটে সব উদযাপন।

প্রায় এক যুগে আগের কিশোর তামিমের এমনই একটি কীর্তি আজও বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টারের মত। টেস্ট ক্রিকেটে কোনো বাংলাদেশির সেরা ইনিংস কোনটি তা নিয়ে হয়তো বিতর্ক হতে পারে তবে সেদিন লর্ডসে তামিম বলে কয়ে যেই দু:সাহস দেখিয়েছিলেন তা আর কেউ পারেনি। লর্ডসে প্রথম কোনো বাংলাদেশির সেঞ্চুরি এবং তারপর সেই ঐতিহাসিক উদযাপনের প্রেক্ষাপট ছিল আরো গভীর।

সেই ছোটবেলায় বড় ভাই নাফিস ইকবাল খান একবার তামিমকে লর্ডসের গল্প বলেছিলেন। বড় ভাইয়ের মুখে শুনেছেন ক্রিকেটের এই তীর্থস্থানে নাকি একটা অনার্স বোর্ড রয়েছে। সেই অনার্স বোর্ডে লর্ডসের নায়কদের নাম লেখা হয়, যে নাম থেকে যায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। বিশ্বের সব ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন থাকে একটিবার ওই লর্ডসে খেলবেন। তবে তামিম শুধু খেলার স্বপ্নই নিয়েই বড় হননি, ভেতরে পুষে রেখেছিলেন আরো বড় কিছু।

তামিমের সেই পুষে রাখা স্বপ্নপূরণের সুযোগ এলো ২০১০ সালে।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ। তার একটি টেস্ট হবে লর্ডসে। তবে টস জিতে সাকিব ফিল্ডিং নিলে তামিমের ব্যাট হাতে নামার অপেক্ষা বাড়লো। তবে তামিম তাঁর এতকাল ধরে পুষে রাখা স্বপ্ন একবারো ভোলেননি। বরং আগের দিন্ টিভিতে এক সাক্ষাতকার দেখে যুক্ত হয়েছে চাপা জেদ। ইংলিশ ক্রিকেটের কিংবদন্তি জিওফ্রে বয়কট সেদিন বলেছিলেন বাংলাদেশ নাকি টেস্ট খেলারই যোগ্য না। এই শব্দ গুলোর জবাব দিবেন বলেই ব্যাট হাতে নামার জন্য যেনো আরো হাঁসফাঁস করছিলেন তামিম।

বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামলে তামিমের ব্যাট যেনো সেদিন সব রাগ উপড়ে ফেলছিল। ইংলিশ পেসার স্টিভেন ফিনকে হ্যাটট্রিক বাউন্ডারি মেরে হাফ সেঞ্চুরিও করলেন সেদিনের ২১ বছরের টগবগে যুবক। তবে ৫৫ রানে রান আউট হয়ে ফিরে গেলেন প্যাভিলিয়নে। তারপর দ্রুত অল আউট হয়ে গেলে ফলো-অনে পড়ে বাংলাদেশ।

সেদিন সন্ধ্যায় মুশফিকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে ওই অনার্স বোর্ডটার দিকে গেলেন তামিম। ওই বোর্ডটার দেখাশোনা করেন পিট। পিটকে সেদিন তামিম বলেছিলেন, ‘হাফ সেঞ্চুরি করলে নাম লেখেন না?’

পিট ভদ্রলোক সহজ জবাব দিয়েছিলেন, ‘না। সেঞ্চুরি করলে তবেই নাম লিখা হবে।’

তখন সেই অনার্স বোর্ডের বিখ্যাত সব নামগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে তামিম মুশফিককে বললেন, ‘ফিফটি ফাইভ, হান্ড্রেড অ্যান্ড থ্রি।’

তামিম কেনো সেদিন ‘হান্ড্রেড অ্যন্ড থ্রি’ বলেছিলেন সেটার ব্যাখ্যা হয়তো তামিম নিজেও দিতে পারবেন না তবে পরের দিন ঠিক ১০৩ রানই করেছিলেন খান পরিবারের এই সন্তান। সেদিন সকাল থেকেই যেনো এক অন্য তামিম। ইংল্যান্ডের ওই কন্ডিশনে ওদের পেসারদের খেলেছেন বাঘের মত। জেমস এন্ডারসন,স্টিভেন ফিনদের যেভাবে খেলছিলেন তখনই বোঝা যাচ্ছিল এটা তামিমের কাছে আর আট-দশটা ম্যাচের মত না। তামিমের সংগ্রহ তখন ৯০ বলে ৮৭ রান। বোলিং করছেন ইংলিশ পেসার টিম ব্রেসন্যান। পরের দুই বলে পরপর দুটি চার মেরে ৮৯ বলে পৌছে গেলেন ৯৫ রানে। তখনই বোঝা যাচ্ছিল কীসের যেনো একটা তাড়া, কী একটা ছোঁয়ার জন্য একেবারে ছটফট করছিলেন। পরের বলটাতেও দুই রান নিয়ে নিজের কাছেই স্ট্রাইক রাখলেন।

এবার ব্রেসন্যানের বলটাকে লং অনের উপর দিয়ে আবারো সীমানা ছাড়া করলেন। ৯৪ বলের একটা শতক, সেই ছোটবেলায় বড় ভাইয়ের কাছে গল্প শোনার পর থেকে যার অপেক্ষায় ছিলেন। তাই শটটা মেরেই ওই পিট ভদ্রলোককে ইশারা করে বললেন , ‘নাও তোমার সেঞ্চুরি, এবার আমার নামটাও ঐ বোর্ডে লেখো। মনে আছে তো? তামিম ইকবাল খান।’

তামিমের সেদিনের সেই উদযাপন আজও আমাদের একইভাবে শিহরিত করে। একটা একুশ বছরের যুবক ইংলিশ পেসারদের লর্ডসে আঁচড়ে আঁচড়ে ফেলছেন। সেই জিওফ্রে বয়কটের জবাব দিবেন বলে, ঐ অনার্স বোর্ডটায় নিজের নাম তুলবেন বলে একটা সেঞ্চুরিও করে ফেললেন। তাইতো সেদিন পিট তামিমকে বলেছিলেন, ‘এই বোর্ডে অনেকের নাম আছে তবে ঘোষণা দিয়ে নাম তুলেছেন এমন একজনই, সেটা তুমি।’

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link