বছরখানেক আগেও নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। শঙ্কার মুখে ছিলো তাঁর সম্ভবনাময় ক্যারিয়ার। অভিষেকেই ভারতের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট নিয়ে জানান দিয়েছিলেন সামর্থ্যের। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পেস বিভাগের ভবিষ্যত তারকা তকমাও পেয়েছিলেন।
অবশ্য অভিষেক ম্যাচের সেই পাঁচ উইকেট নেওয়ার আনন্দটা ফিঁকে হয়ে যায় বাংলাদেশি ব্যাটারদের হতশ্রী পারফরম্যান্সে! অভিষেকেই নিজেকে প্রমাণ করা তাসকিনের ক্যারিয়ার থমকে গিয়েছিলো মাঝপথেই! কিন্তু এরপরই রূপকথার গল্পের মতো পালটে গেলো সবকিছু। রাজকীয় এক প্রত্যাবর্তনে তাসকিন এখন অদম্য, অপ্রতিরোধ্য!
সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে সেঞ্চুরিয়নে একের পর এক উইকেট হারিয়ে ধ্বংসস্তূপে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং শিবির। মালান, প্রিটোরিয়াস, মিলাররা কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছিলেননা তাসকিনের অগ্নিঝড়া বোলিংয়ের সামনে। তাসকিনের বিধ্বংসী স্পেলে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় করে বাংলাদেশ। ম্যাচ সেরার সাথে সাথে সিরিজ সেরার পুরষ্কারটাও উঠেছে এই পেসারের হাতে!
একটু পেছনে ফেরা যাক। দু’বছর আগে ২০১৯ বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তে এক দুপুরে মিরপুর জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অ্যাকাডেমি ভবনের সামনে সাংবাদিকদের জটলা। এই জটলা তাসকিনকে নিয়েই! বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ডাক পাননি, অনূভুতি কেমন – সেসব জানতেই মূলত তাসকিনকে ঘিরে ধরা। ওই বিশ্বকাপ খেলার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটি পণ্ড হয়ে যাওয়ায় মিডিয়ার সামনে কথা বলতে গিয়ে অশ্রসিক্ত হয়ে পড়েন তাসকিন। তিনি বলেছিলেন, ‘চেষ্টা করবো, পরিশ্রম করবো আরও। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে তখন সেরাটা দিবো।’
অবশ্য খারাপ লাগার কারণও ছিলো। চোট কাটিয়ে ফিরেছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। সেখানে দেখিয়েছিলেন নজরকাঁড়া পারফরম্যান্সও। তবুও ফিটনেস ইস্যুতে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ছিলেন উপেক্ষিত।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর ২০১৫ বিশ্বকাপে ছিলেন দলের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো কন্ডিশনে গতি আর বাউন্সারে বাংলাদেশের হয়ে সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন ভবিষ্যত তারকা খ্যাতির তকমাও। এরপরই হঠাৎ ছন্দপতন! তাসকিন যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন! তিনি ফিরবেন কিনা সে নিয়ে তো সংশয় ছিলো। সোশ্যাল মিডিয়ায় রান মেশিন থেকে শুরু করে ট্রল আর হাসাহাসির পাত্র বনে যান তিনি।
২০১৭ সালে ইস্ট লন্ডনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতে বাদ পড়ার আগের ম্যাচে ৭ ওভারে ৬৬ রানে দুই উইকেট নেন তাসকিন! সেই ম্যাচে ২০০ রানের বিশাল ব্যবধানে প্রোটিয়াদের কাছে হার মানে বাংলাদেশ দল। ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায়ও পড়ে। পরের সিরিজেই দল থেকে বাদ তিনি। এরপর চোট আর ভাগ্য সহায় না হওয়ায় তিন বছর গায়ে জড়াতে পারেননি জাতীয় দলের জার্সি।
২০১৭ সালের অক্টোবরের পর প্রায় ১১৬৪ দিন ছিলেন ওয়ানডে দলের বাইরে! টেস্টেও সুযোগ পাননি। ২০১৮ সালে ২ টি-টোয়েন্টি খেলার পর জাতীয় দলের বাইরে! এরপর প্রায় তিন বছর জাতীয় দলের রাডারে ছিলেন না এই পেসার। চোট কাটিয়ে ফিরলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে তখন বেশ ভালোই করছিলেন। কিন্তু চোটের কারণে ফিটনেস ইস্যুতে ছিলেন খানিকটা পিছিয়ে। তাই তাসকিনের উপর ১৯ বিশ্বকাপে ভরসা রাখতে পারেনি বিসিবিও! বিশ্বকাপে সুযোগ না পেয়ে ভেঙে পড়েন এই পেসার। তবে সেই স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় মোটেও দমে যাননি তাসকিন।
এরপর বিশ্বজুড়ে করোনার হানায় ক্রিকেট তো বটেই থমকে গেলো পুরো বিশ্ব। সবকিছু থেমে গেলেও তাসকিন চালিয়ে যান অনুশীলন। নিয়মিত জিম সেশন সহ বোলিং প্র্যাকটিস কোনো কিছুতেই ছাড় নেই। সবকিছু থেমে গেলেও থেমেও যাননি তাসকিন। শরীরে টায়ার বেঁধে বালুতে দৌড়ানো কিংবা আগুনের চাটাইয়ের উপর হেঁটে চলা – লক্ষ্য একটাই, স্বপ্ন একটাই। আবারও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানো।
এর জন্য প্রয়োজন ছিলো শুধু নিজেকে প্রমাণের একটি সুযোগ। সেটা পেতে অবশ্য বেশি দেরি হয়নি! করোনার মাঝেই বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ ও বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ আশীর্বাদ হয়ে এলো তাসকিনের জন্য। বিসিবি প্রেসিডেন্ট কাপে পাঁচ ম্যাচে ৪.৪৮ ইকোনমিতে নেন সাত উইকেট। ১৪০ এর আশেপাশে গতি আর নিঁখুত লাইন-লেন্থ ছিলো দেখার মতো। বিসিবি প্রেসিডেন্ট কাপে ঈর্ষনীয় পার্ফরমেন্স করার পর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপেও সুযোগ পেলেন ফরচুন বরিশালের হয়ে খেলার। ৯ ম্যাচে ৮.৪৫ ইকনোমিতে সেখানে শিকার করেন ৭ উইকেট।
সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ান তাসকিন। আবারও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ফেরা। এরপরের পথটা এখন অবধি স্রেফ সফলতার চাদরে মোড়ানো। এবার আর পা হড়কাননি! পরিশ্রম, ইচ্ছাশক্তিকে রূপ দিয়েছেন সাফল্যে।
ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যবইয়ে পড়েছি অথবা বেড়ে উঠার পথে বিভিন্ন ভাবেই শুনেছি কোনো ক্ষেত্রেই সফলতার প্রথম শর্ত হল প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রম। মানুষ যদি তার লক্ষ্যে অটুট থাকে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে, তবে একদিন সে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে পারে। উদ্যম, চেষ্টা আর শ্রমের সমষ্টিই কিনা সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। তাসকিনের সৌভাগ্য কিংবা সফলতার পেছনে আছে ইচ্ছাশক্তি আর কাঠ-খড় পোড়ানো পরিশ্রম।
সবশেষ শ্রীলঙ্কার মাটিতে পাল্লেকেলেতে সাদা পোশাকে প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন ধারাভাষ্যে থাকা রাসেল আর্নল্ড, পারভেজ মাহরুফদের। পাল্লেকেলের পাটা উইকেটে নিয়েছিলেন সাত উইকেট; তাও কি’না প্রায় চার বছর পর সাদা পোশাকে প্রত্যাবর্তন! এরপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে চার ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক ইনিংসে নেন তিন উইকেট।
গেলো বছর ফিরেন টি-টোয়েন্টিতেও। ২০২১ সালে ১৪ ম্যাচে ৭.৬৬ ইকোনমিতে নেন ১১ উইকেট! ওয়ানডের প্রত্যাবর্তনটা আরও রাজকীয়! গেলো বছর ১০ ম্যাচে ৫ ইকোনমিতে নেন ১০ উইকেট, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুরে এক ম্যাচে চার উইকেট নেন এই পেসার। চলতি বছর খেলেছেন ৬ ম্যাচ। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে শিকার করেছেন ৮ উইকেট! আফগানিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠেও তিনি ছিলেন দুর্দান্ত।
তাসকিনের বলে ক্যাচ মিসের মহড়া না দেখালে হয়তো আরও ডজনখানেক উইকেট থাকতো তাঁর নামের পাশে। এদিক থেকে নিজেকে কিছু দূর্ভাগা মানতেই পারেন।
গেলো বছর ২০২১ সালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছিলেন, ‘তাসকিনকে শুধু টেস্ট ও ওয়ানডেতেই বিবেচনা করা হবে।’ সেই তাসকিন এখন তিন ফরম্যাটের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে! তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। টানা ব্যর্থতার পরেও দমে না গিয়ে ফিরে আসার সেরা চেষ্টাই করেছেন বারং বার।
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে তাসকিনের অগ্নিঝরা বোলিং নজর এড়ায়নি বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আইপিএলেও। সিরিজের মাঝপথেই সুযোগ পেয়েছিলেন লখনৌ সুপার জায়েন্টসের হয়ে খেলার। অথচ দুইদিনের মেগা নিলামে ড্রাফট থেকে ডাকাই হয়নি তাসকিনের নাম!
প্রতিভা দিয়েই সব হয় না, সফলতার জন্য প্রয়োজন প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম। এর জ্বলন্ত প্রমাণ তাসকিন। হ্যাঁ, এখনো পাড়ি দিতে হবে লম্বা পথ। ১৫০ গতিতে বল করার লক্ষ্যটাও হয়তো পূরণ করে ফেলবেন। কঠোর পরিশ্রম, ডেডিকেশন, প্যাশন সব মিলিয়ে তাসকিন এখন অপ্রতিরোধ্য, অদম্য! বছর দুয়েক আগে আবেগ ধরে রাখতে না পেরে মিডিয়ার সামনে অশ্রুসিক্ত হওয়া তাসকিনের হাসির চিত্র এখন পুরো ক্রিকেট দুনিয়ায়!