মনে পড়ে ১৯৯৯-এর সিরিজে বোধহয়, জাভাগাল শ্রীনাথের একটা বাউন্সার পন্টিং-এর মাথায় আছড়ে পড়তেই উৎকণ্ঠিত শ্রীনাথ পন্টিং-কে জিজ্ঞাসা করতে গেলেন সব ঠিক আছে তো? ডান হাতে ব্যাট নিয়ে পন্টিং চোখা চোখা বিশ্লেষণে ভরিয়ে দিয়ে শ্রীনাথকে বোলিং করতে ফিরে যেতে বললেন। ভুল বললাম, ‘ফা… বোলিং’ করতে ফিরে যেতে বললেন। শ্রীনাথও বাধ্য ছেলের মতো ফিরে গেলেন।
আসলে ক্রিকেট কেন, যে কোনও মাঠে আক্রমণত্মক শরীরী ভাষা একটা অন্য অবস্থার সৃষ্টি করে। মানসিক ভাবে চাপ তৈরি করে এবং একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে সেই চাপটা প্রয়োগ করা খেলাটাকেই আরও উত্তেজক বানিয়ে ফেলে।
নাটক, মানুষ নাটক দেখতে পছন্দ করে। দিনের পর দিন একতা কাপুরের রিগ্রেসিভ সিরিয়ালগুলো অথবা নাটুকে নিউজ চ্যানেলগুলোর উচ্চকিত বিস্ফোরণ হাঁ হয়ে গেলে। ভালো খারাপ বলছি না, তবে ম্যাদামারা জীবনে নাটকের একটা ভূমিকা আছে।
একইভাবে সঠিক মাত্রায় আগ্রাসনেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। একটু ছোট্ট করে দেখে নিই, কাল ঠিক কী হল। লর্ডস টেস্টের শেষ দিন।
শেন ওয়ার্নের একটা কথা মনে পড়ে যায়, মেন্টাল ডিসইন্টিগ্রেশন বা গোদা বাংলায় মানসিকভাবে ছড়িয়ে ফেলা। ইংল্যন্ডের ক্ষেত্রে সেটাই হল। আর এটা কে করিয়েছে, কেন করিয়েছে এসব আপনারা যাঁরা মন দিয়ে ক্রিকেট দেখেন তাঁরা বিশ্লেষণ করুন। আমি বরং ঘটনাটার কথা মনে করিয়ে দিই। তৃতীয় দিনে হঠাৎ করে বর্ষিয়ান জিমি অ্যান্ডারসনকে বাউন্সার বিষে ভরিয়ে দিলেন বুমরাহ। ভুল ঠিক এসব নিয়ে কথা বলছি না। ক্রিকেট খেলাটা যখন শুধুমাত্র সাদা পোশাকে হত তখন বলা হত যে টেল এন্ডারদের বাউন্সার দেওয়াটা নৈতিকতার বিরুদ্ধ।
জিমি অ্যান্ডারসন যে খুব ভদ্রলোক, এটা তাঁর অতিবড় শত্রুও দোষারোপ করবেন না। বিগত ট্যুরে রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল সেটা এখনও স্পষ্ট না হলেও ভাল করে ঘাঁটাঘাঁটি করলে, ঠিক কে কী শুরু করেছিল ধরে ফেলবেন। তবে স্টুয়ার্ট ব্রড, জোফরা আর্চার বিহীন এই বোলিং আক্রমণে জিমি অ্যান্ডারসন নেতা, মাস্তুল বা ভিত।
যদিও ইংল্যন্ডের ইনিংস শেষ হবার পরে স্মাইলিং অ্যাসাসিন বুমরাহ জিম্মিকে কাঁধে হাত দিয়ে স্পোর্টিংলি নিতে বলেন, কিন্তু তিনি যে নেননি তা তাঁর শরীরী ভাষাতেই স্পষ্ট হয়।
এমনিতেই এখন বিতর্ক উঠে গেছে জো রুট না কেভিন পিটারসেন, কে আধুনিক ইংল্যান্ড ক্রিকেটের সেরা ব্যাটার। হ্যা, অ্যালিস্টেয়ার কুক, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস বা গ্রাহাম গুচ থাকলেও প্রভাবের দিক থেকে কেভিন পিটারসনের সমকক্ষ শুধুমাত্র বেন স্টোকসই। কিন্তু ব্যাটিং শুধু বিচার্য হলে?
জো রুটের ব্যাটিং-এর সঙ্গে কেন উইলিয়ামসনের ব্যাটিং-এর খুব মিল। আধুনিক ক্রিকেটের সুষমা এদের ব্যাটিং-এ আপনি পাবেন না যেখানে শক্তির সঙ্গে সৌন্দর্য্যের মিশেল হয়েছে। আবার আধুনিক ক্রিকেটের বিশেষ একটি ধারা অনুসরণ করে উভয়েই বলকে অফসাইডে রেখে খেলেন। তবে পুরনো দিনের ব্যাটিং-এর মতো এঁরা দুজনেই জবরদস্তি মাথা সোজা করে সমান্তরালে দুই চোখে বোলারকে দেখা অথবা সামনের হাতের কনুইটা রাডারের মতো বোলারের দিকে করা বা পিঠ সোজা করা এগুলো করেন না।
দুজনেরই ব্যাটিং-এর মূল কথা ব্যাল্যান্স। এবং বর্তমানে এরা দুজনেই বোধহয় টপ ফর্মে রয়েছে। মানে টেস্ট ক্রিকেটে অন্তত: তাঁরা দুজনের ফর্মই সেরা। লাবুশেন বা স্মিথ এদের পরে চলে আসবেন। আর বিরাট কোহলির সবকিছুর পরেও টুক করে আউট হয়ে যাবার একটা সমস্যা হচ্ছে।
সে যাক, জো রুটের ফর্ম এখন সুপারলেটিভ। কিন্তু জো রুট ছাড়া এই দলটায় সেরকম ফর্মে কেউই নেই। বেয়ারস্টো বাটলার কবে রান করবেন সেটা কেউ জানেন না। কিন্তু লিঞ্চপিন জো রুট।
একইভাবে বোলিং-এ ওলি রবিনসন দুর্দান্তভাবে উঠে এলেও সেই লিঞ্চপিন জিমি অ্যান্ডারসন। কিন্তু তাঁরও বয়স হয়েছে এবং দীর্ঘ পাঁচ টেস্টের সিরিজে পুরোটা খেলা অসুবিধাজনক।
যদিও চতুর্থদিনের শেষাশেষি মার্ক উডের পেস ভারতীয় ব্যাটিংকে ধ্বসিয়ে দিয়েছিল, তবু পূজারা ও রাহানে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় কিছুটা লড়াই করা গেল। রাহানে ধারাবাহিক নন। কিন্তু সমস্যাটা মনে হয় পূজারার ক্ষেত্রে অনেক বেশি গভীর। টিম ম্যানেজমেন্ট সেই জায়গায় একটা ঠিকঠাক লোক চাইতেই পারে। পূজারা যত বল নিচ্ছেন, তত বলে যে স্ট্রাইক রেট রেখে রান করছেন তাতে প্রচুর রান হচ্ছে না। ফলে বোলিং ফ্রেন্ডলি কন্ডিশনে যদি একটা ভালো বলে আউট হচ্ছেন তো দল চাপে পড়ে যাচ্ছে।
এমনিতে এই ডিউক বল উপরের ল্যাকার বা পালিশের পরত উঠে গেলে শুধু মাত্র ট্যান্ড চামড়ার পালিশে অনেক বেশি স্যুইং করে। ফলে ৩০ ওভারের পরে স্যুইং অনেক ভালো হয়ে যায়। ফলত পুরোটাই টেল এন্ডারদের উপর পড়ছে।
এই কাজটা জন রাইট করতেন। টেলএন্ডারদের নিয়ে আলাদা করে খাটা। বিক্রম রাঠোর করছেন কি না সঠিক বলতে পারব না, তবে কিছু একটা কেউ একটা করছে সেটা ইশান্ত, বুমরাহ, শামির ব্যাট করার ধরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
তবে পঞ্চম দিন একটা সুযোগ এসেছিল ইংল্যন্ডের হাতে, যখন পন্থ আউট হন। কিন্তু ইংল্যন্ড সেই সুযোগটা হারায় সিনিয়র সিটিজেন জিমি অ্যান্ডারসনের রক্ষাকর্তা হিসাবে বাকি বোলাররা দাঁড়াবার চেষ্টা করায়। সেই ‘পিকে’ ছবিতে একটা ডায়লগ ছিল না? ভগবান আপনা রক্ষা খুদ কর শকতা হ্যায়। জিমি অ্যান্ডারসনও। কিন্তু সে কথা ওলি, মার্ক বা রুটকে কে বোঝাবে?
বুমরাহ ব্যাট করতে নামার পরে যেটা শুরু হল, সেটা আত্মহত্যা ছাড়া কিছুই না। আজ শুরুতে জিমি মাত্র তিন ওভার বল করেছিলেন। মার্ক উডের কাঁধের হাড়ে চোট। সব পেরিয়ে মার্ক উড আর ওলি রবিনসন শামি আর বুমরাহর শরীর লক্ষ্য করে গোলাগুলি ছুঁড়তে শুরু করলেন। ঠিক তখনই যখন পঞ্চম দিনের পিচে বল ওঠানামা করছে এবং রীতিমত সিম মুভ করছে।
শামি-বুমরাহ যথেষ্টই ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন। আর এটাই বোধহয় পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের। তিরিশ ওভারের পরে যখন বল সিম আর স্যুইং করছে সে সময় শর্ট ফেলে সুযোগ নষ্ট করা বা ল্যাজ দীর্ঘায়িত করা শুরু হল। তারপর ব্যাটে বলে হতে শুরু করলে জো রুটকে একদম উদ্দেশ্যহীল লাগতে শুরু করে। অধিনায়কের শরীরের ভাষা বাকি দলের মধ্যেও চারিত হয়। ফলস্বরূপ যে লিডটা মেরেকেটে দেড়শর মধ্যে আটকে যেত সেটা হয়ে দাঁড়ায় ২৭১।
ব্যাস, পুরোটাই না হলে অধিকাংশটাই এই শরীরী ভাষার গল্প। বিচক্ষণ অধিনায়ক শুরুই করলেন বুমরাহ আর শামিকে দিয়ে। সঞ্জয় মাঞ্জরেকার স্টুডিওতে বসে একটা কথা বললেন যে এই কম রান বাঁচাবার সময় বিরাটের সিদ্ধান্তগুলো ঠিক ঠাক জায়গায় হয়। ইন্সটিঙ্কট না ক্রিকেট প্রজ্ঞা সেটা বিচক্ষণ ক্রিকেট বিশ্লেষকরা ঠিক করুন। তবে আলফা মেলরা নিজেদের শরীরের ভাষা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। সৌরভ গাঙ্গুলির কথাই ধরুন না।
প্রত্যেক বোলারই নিজের কাজটুকু করে গেলেন, ইশান্ত, সিরাজ প্রত্যেকেই। যেমন চা বিরতির ঠিক আগেই ইশান্তের বলে বেয়ারস্টোর আউটটা। তবে আজ বুমরাহ যে চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখালেন সেটা অনবদ্য। বল যখন সিম করতে শুরু করেছে, তখন বুমরাহ তাঁর কব্জির মোচড়ে অতিরিক্ত গতি বাউন্স বা সিম মুভমেন্ট আনতে শুরু করলেন। জো রুট এই ইংল্যন্ড দলের প্রাণভোমরা।
কিন্তু, আগেই বললাম তিনি বল সাইডে রেখে খেলেন। সেই সুযোগটা নিয়ে বুমরাহ রিটার্ন ক্রিজের ধার ঘেঁসে মারণবাণটি ছাড়লেন। আগেরটি উইকেটের ধার ঘেঁসে করা বল, রুটের ছাড়তে অসুবিধা হয়নি। এটিও বাইরেই যাচ্ছিল, কিন্তু রিটার্ন ক্রিজের ধার ঘেঁসে ছাড়ার ফলে একটা কোণের সৃষ্টি করল এবং সিম করে বল যখন সোজা হয়ে ছোবল মারল তখন রুট কমিট করে ফেলেছেন। বলের এক পাশে খেলার খেসারত দিলেন তিনি। ইংল্যন্ডও ধ্বসে পড়ল।
মোহাম্মদ সিরাজের উত্থানের মূল কারণ যদি হয় তাঁর সিংহহৃদয় তাহলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল তাঁর অ্যাকশনের ফলে বল পিচ পড়ার পর স্কিড করে। বল স্যুইং করার সময়ও বা স্ক্র্যাম্বল্ড সিমে সিম মুভ করার ক্ষেত্রেও ছিলা থেকে ছিটকে বেরনো বাণের মতো তার গতি ধরে। ফলে সামান্য দিক পরিবর্তনে ব্যাটসম্যানের পক্ষে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। আজও হল।
ঋষাভ পান্তের কিপিং এখন অনেক উন্নত। বিশেষ করে পেস বোলিং-এর বিরুদ্ধে। এর পিছনে হয়তো ঋদ্ধির হাত রয়েছে। নিজের জায়গা চলে যাবার থেকেও বড় কথা দলের ভালো হবে, এই উপলব্ধিটা দলের প্রতিটি সদস্যের মধ্যেই রয়েছে।
আর বিরাট। ব্যাটে শুধু তাঁর নয়, তিন সিনিয়রেরই রান নেই। কবে শেষ সেঞ্চুরি করেছেন ভুলেই গেছেন। কিন্তু বাইশ গজের আসেপাশের জায়গাটা তাঁর এখনও, একান্তই ভাবে তাঁর। আগ্রাসন অপরকে হত্যা করার জন্য নয়। একটা ঝড় তোলার জন্য। একটা পজিটিভ চিন্তা, ‘পারতেই হবে’র চাপ থেকে পেরিয়ে ‘পারবোই’য়ের নিশ্চয়তা নিয়ে আসে। আর ফলাফল আপনার সামনে।
অনেকেই বলছেন ২০১৪ বা আগের সিরিজের মতো হবে না তো? না হবার সম্ভাবনা। কারণ ২০১৪ সালেরটা আলাদা ধোনির হয়তো টেস্ট ক্রিকেট খেলতে আর ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু গত ইংল্যন্ড ট্যুরে একমাত্র একটি টেস্ট ছাড়া তুল্যমূল্য লড়াই দিয়েছিল ভারত। শুধুমাত্র ইংল্যন্ডের টেল এন্ডারদের ব্যাটিং বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এবারে ব্রড, স্টোকস, ওকস নেই রয়েছেন কুরান। তিনিও বোধহয় পরের টেস্ট খেলবেন না। আর ডম সিবলিদের নিয়ে আর যাই হোক দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করা চলে না।
অতএব মধ্যমাটি তর্জনীর উপর তুলে বসুন। দেখুন না কী হয়! সব কিছু তো আলোর নিচে ফেলে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার দিব্যি কেউ দেয়নি। উপভোগ করাটাও তো জরুরি। হয়ত বিশ্লেষণের থেকেও জরুরি। তাই না?
আমার এক পরিচিত দাদা কালই জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে সুনীল গাভাস্কার হ্যানাত্যানা বলেছেন, তোর কী মনে হয়? আমি দুকান জিভ কেটে বললাম, আমার কিসসু মনে হয় না। গাভাস্কারের বলার উপরে বলার মত জায়গায় আমি কখনই নেই! এটাই খেলা নিয়ে লেখার সময় মনে হয়।