অচলায়তন ভাঙার গান

ফিটনেস টেস্টে পাস করার ফল শুনে খুশিতে নাকি রাতে ঘুমাতেই পারেননি সালমা। ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে অনার্স পাশ করছেন সালমা। নেত্রকোনা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্বপ্ন দেখতেন দেশরো অ্যাথলেট হওয়ার। এরপর জেলার হয়ে ঢাকায় খেলে গেছেন জাতীয় জুনিয়র মিটে; হাই জাম্পে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জপদক। বিকেএসপিতে অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে পড়াকালে দুইবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেলেও নিচের ক্লাসে ভর্তি হতে অনিচ্ছুক হওয়ায় প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। পরে স্কুলের হ্যান্ডবল ও কাবাডি দলে খেলেছেন।

এ যেন নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি, এ যেন অচলায়তন ভাঙার গান গাওয়া শুরু করে দিয়েছেন তিনি। নারী রেফারী হিসেবে দেখা স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হয়েছে সালমা আক্তার মনি’র। বাংলাদেশের পেশাদার ফুটবলে প্রথম নারী রেফারী হিসেবে ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনা করেছেন তিনি।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলের (বিপিএল) উত্তর বারিধারা-আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের ম্যাচটাকে বেছে নিয়েছেন মাইলফলক অর্জনের জন্য। আর কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম বিরল এই কৃতিত্বের স্বাক্ষী হয়ে রইল। যদিও ১-০ গোলে পরাজিত হয়ে ম্যাচটিকে আজীবনের জন্য ভুলে যেতে চাইবে আরামবাগ। কারণ এই পরাজয়েল ফলে বিপিএল থেকে অবনমন একপ্রকার নিশ্চিতই হয়ে গেছে মতিঝিল ক্লাব পাড়ার দলটির। আরামবাগের পরাজয়কে এক কোনায় রেখে মনি’র অনন্য সাধারণ কৃতিত্ব এই ম্যাচের গুরুত্ব বাড়িয়েছে বহুগুণ। সহকারী রেফারী হিসেবে মাঠের এক পাশে অনেকটা ছেলেদের মতোই দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে একজন নারী হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন।

এখন থেকে কেউ যদি এমন অর্জন করেন সেক্ষেত্রে তাকে দ্বিতীয় হতে হবে। প্রথম হিসেবে এই ক্লাবের এক নাম্বার নামটি থাকবে সালমা আক্তার মনি’র। তার ম্যাচ পরিাচলনার বিষয়টি আগে থেকে নির্ধারিত থাকলেও সেভাবে জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন-বাফুফের রেফারিজ কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান ইব্রাহিম নেসার বলেন, ’সালমা ইসলাম এবার তো ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশের প্রথম নারী রেফারি হিসেবে ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনা করে সৃষ্টি করলেন নতুন এক ইতিহাসের। এর আগে দেশের ফুটবলে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি।’

এরই মধ্যে সালমার নাম এলিট রেফারি প্যানেলের জন্য ফিফায় পাঠানো হয়েছে। ম্যাচ পরিচালনার জন্য ফিফা ভিডিও চেয়ে পাঠিয়েছে। যার পিরপ্রেক্ষিতে ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনায় সালমাকে যুক্ত করেছে রেফারিজ কমিটি। ২০২০ সালে পরীক্ষায় পাস করে ২০২১ সালের জন্য ফিফার সহকারী রেফারি হয়েছেন সালমা। রেফারিং করার পাশাপাশি ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে স্নাতক করছেন তিনি।  ম্যাচ পরিচালনা করার অনুভূতিটা ভিন্ন জানিয়ে সালমা বলেছেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি এই ভাললাগার অনুভুতির সাথে কোন অনুভুতিরই মিল খুজে পাওয়া যাবেনা। অনেক অনেক ভালো লাগছে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনায় মনোযোগ বেশি দিলেও পরিশ্রমক করে সফল হওয়ায় আমি খুশি হয়েছি’।

গত বছরই জয়া চাকমা ও সালমা আক্তার মনি এএফসি’র রেফারিং কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই কোর্সে তারা দুজনেই ভালো পারফরম্যান্স করেছেন। এএফসি এলিট কোর্সে প্রবেশ করতে তাদের ফিটনেস ও গেম পরীক্ষার ভিডিও চেয়ে পাঠিয়েছে এএফসি। সাবেক ফিফা রেফারি ও বাফুফের হেড অফ রেফারিজ আজাদ রহমান উচ্ছসিত কণ্ঠে বলেন, ’বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য আজকে এক ঐতিহাসিক দিন। আমরা পুরুষদের পাশাপাশি নারী রেফারিং নিয়েও বিশেষভাবে কাজ করছি। জয়া এবং সালমা খুবই সম্ভাবনাময় বিধায় তাদের নিয়ে আশাবাদী।’

বিকেএসপি থেকে ছুটি নিয়ে জয়া এখন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছেন ভারতে। জয়ার রেফারিং পরীক্ষা ও প্রস্তুতি হচ্ছে ভারতের জামশেদপুরে। জয়া চাকমা রেফারি ও সালমা সহকারি রেফারি হিসেবে ফিফায় উত্তীর্ণ হয়েছে ২০২০ সালে। তারা এখন এএফসি এলিট প্যানেলে প্রবেশ করতে পারলে এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের নারী প্রতিযোগিতাগুলোতে খুব সহজেই রেফারিং করতে পারবে।

অধরা স্বপ্নটা অবশেষে পূরণ হয়েছে সালমা আক্তার মনি’র। খেলোয়াড় হিসেবে মাঠের ফুটবলটাকে এখনো আকড়ে ধরে রাখার কথা তার। কিন্তু সেটিকে পেশা হিসেবে না নিয়ে এখন পুরদস্তুর রেফারি হয়েছেন। আরো আগেই অর্জনের স্বীকৃতি পেতে পারতেন। কিন্তু বয়সের মারপ্যাচে পড়ে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে এই আর কি। এখন ঠিকই ফিফা রেফারী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

২০২০ সালের জন্য পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর রেফারি হিসেবে আন্তর্জাতিক ম্যাচে কাজ করার অনুমতি পাননি। বয়স এক বছর একদিন কম হওয়ায় স্বীকৃতি পাননি। অপেক্ষায় ছিলেন ২০২১ সালের জন্য তাকে অনুমোদন দেওয়ার। অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত ফিফার সেই অনুমোদন পেয়েছেন তিনি। সম্প্রতি মনি’তে ফিফার সেই অনুমোদনের বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে ফিফা।

সালমা আক্তার মনি এখন ফিফার সহকারী রেফারি। এবারো তার বয়স একদিন কম ছিল। কিন্তু বাফুফে ফিফাকে একদিন বয়স বিবেচনার অনুরোধ করলে সেটি গ্রহন করে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থাটি। সে হিসেবে এখন বয়স একদিন কম হলেও ফিফার সহকারী হিসেবে কাজ করার স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ মনি’কে ফিফার স্বীকৃতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে মনি’র আগে রেফারি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের কারণে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পাননি আরেক নারী রেফারি জয়া চাকমা। গত বছরের মতো এবারও এই দুইজন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফিফার অনুমোদন পেলেন। নতুন বছরে তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খেলা পরিচালনা করার সুযোগ পাবেন বলে জানা গেছে। মেয়েদের খেলাধুলায় প্রতিবন্ধকতা কিছুটা কমলেও এখনো পুরোপুরি নিরাপদ আর সুরক্ষিত নয়।

নানা প্রতিকুলতা পেরিয়ে সমাজের বাকি পেশাগুলোর চেয়ে একটু বেশিই আড় চোঁখে তাকানো হয়ে থাকে নারী খেলোয়াড়দের। এসব নিয়ে না ভেবে বরং নিজেকে নিয়ে ভাবতেই বেশি পছন্দ করে থাকেন তারা। অনেকে আবার পরিবার থেকে উৎসাহ পেলেও বাইরের মানুষদের কাছ থেকে সেভাবে সহায়তা পাননা। এত নৈতিবাচকতার মধ্যেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় সকল খেলাতেই এখন নারীদের অংশগ্রহন চোঁখে পড়ার মতো। তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে জয়া চাকমা আর সালমা আক্তার মনিকে।

এর আগে গত বছর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফিফার নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা দিতে হয়েছে তাদের। দুজনই ৪ হাজার মিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এছাড়া আরও কিছু কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। প্রয়োজনীয় এসব পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন জয়া আর সালমা। এই দুজনের মধ্যে আবার একটু বেশি কষ্ট করতে হয়েছে সালমাকে। সালমা আক্তার মনি’র বর্তমান বাস নেত্রকোনা জেলা সদরে হলেও পাঁচ বছর আগে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন ছিল।

খেলোয়াড় হিসেবে সফল হতে না পারলেও রেফারি হিসেবে এরই মধ্যে ঢাকায় বেশকিছু ম্যাচ পরিচালনা করার করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। শুরুতে গ্রামে অনেকেই অনেকরকম কথা বলতেন। কিন্তু পরে যখন ঢাকায় কয়েকটি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন তখন পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। কয়েকটি পত্রিকায় ছবি ছাপা হওয়া আর টিভিতে ছবি দেখানোর পর দ্রুতই মানুষের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে।

মানুষের মধ্যে বাড়তে থাকে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিও। আর এখন তো নেত্রকোনাবাসীর কাছে এক অহংকারের নাম হয়ে আছে এই সালমা। অথচ নানা কারণে বছর দুয়েক আগে বাশি বাজানো একরকম ছেড়েই দিতে চেয়েছিলেন। ২০১৭ সালে ফিফা রেফারী পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হওয়ার পর থেকেই কিছুটা অনীহা তৈরি হয়েছিল। মনের ভেতর তৈরি হয়েছিল এক ধরনের অবসাদ।

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর ফিফা রেফারী মাহমুদ জামাল ফারুকী নাহিদ তাঁকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়েছিলেন। ভুটানে অনুর্ধ্ব-১৫ নারী সাফ শেষ করার পর থেকেই একটু একটু করে বাড়তে থাকে আত্ববিশ্বাস। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন পেছনে যা হয়েছে সেগুলো ভুলে নতুন করে শুরু করতে হবে। এরপর সেই আত্মবিশ্বাসের বলে বলীয়ান হয়ে ৬ মাস কঠোর পরিশ্রমের ফল হিসেবে জয়া চাকমার মতো তিনিও পাস করেছেন ফিফা রেফারি পরীক্ষা। সাথে গড়েছেন ইতিহাস।

ফিটনেস টেস্টে পাস করার ফল শুনে খুশিতে নাকি রাতে ঘুমাতেই পারেননি সালমা। ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে অনার্স পাশ করছেন সালমা। নেত্রকোনা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্বপ্ন দেখতেন দেশরো অ্যাথলেট হওয়ার। এরপর জেলার হয়ে ঢাকায় খেলে গেছেন জাতীয় জুনিয়র মিটে; হাই জাম্পে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জপদক। বিকেএসপিতে অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে পড়াকালে দুইবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেলেও নিচের ক্লাসে ভর্তি হতে অনিচ্ছুক হওয়ায় প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। পরে স্কুলের হ্যান্ডবল ও কাবাডি দলে খেলেছেন।

২০১৩ সালে নারী ফুটবল দলের হয়ে ময়মনসিংহে বিভাগীয় পর্যায়ে খেলতে আসার পর পাল্টে যায় সালমার জীবন। নারী ফুটবলার সংকটের কারণে ছেলেদের সঙ্গে অনুশীলন করতে হতো তাকে। সে বছর ফিফা রেফারি ফেরদৌস আহমেদের উৎসাহে রেফারিং কোর্স করা। এরপর এএফসির ১৫ টিরও বেশি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন, দুটিতে বাঁশি বাজিয়েছেন, বাকিগুলোয় সহকারী। এখন নিশ্চয়ই স্বপ্নটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে তাঁর।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...