টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ: ভাল/মন্দ

রাতারাতি কেউ খারাপ ব্যাটসম্যান বা বোলার হয়ে বোধহয় যান না। ফর্মের তারতম্য ঘটতেই পারে। তাই গড়ের এতো ফারাক বোধহয় পিচ এবং কন্ডিশনের ওপরেই বর্তায়। যা বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ পরবর্তীকালেই হয়েছে বলে মনে হয়। কাজেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফলে কনটেক্সট তো এসেছে, কিন্তু পিচের সাধারণ চরিত্র বদলে গেছে। অর্ডারি পিচের গাদি লেগে গেছে। এবং ঠিক সেই কারণেই ব্যাটসম্যানদের লিলিপুট ও বোলারদের গালিভার মনে হচ্ছে।

সেদিন একটা প্রশ্ন রেখেছিলাম, যে বর্তমানে সার্বিক ভাবে ব্যাটিং গড় এতো কম কেন? বোলিংয়ের মান বেড়ে গেছে, নাকি ব্যাটিংয়ের মান কমে গেছে? অনেক ভাবনা চিন্তা করে আর একটা সম্ভাব্য কারণ মাথায় এলো। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। কনটেক্সট বিহীন ক্রিকেটের মাইকেল হোল্ডিং একটা সুন্দর নামকরণ করেছেন – ‘মিকি মাউস ক্রিকেট’।

তা ক্রিকেটে ‘কনটেক্সট’ ফেরানোর জন্যে আইসিসি. আজকাল সব ওয়ানডে বা টেস্টকেই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও ওয়ানডে সুপার লিগের অন্তর্গত করেছে। ওয়ানডেতে ঠিক এই কারণে বিশাল বদল বোধহয় সম্ভব নয়, কারণ ওয়ানডের স্বাভাবিক ভাবেই একটা ফলাফল হয়। টাই হলেও তাঁর সংখ্যা হাতে গোনা।

টেস্টে অনেক সময়ে পাঁচ দিন খেলেও কোনো ফলাফল হয় না। এছাড়া অনেক সময় কোনো একটি দল সিরিজ জিতে গেলে, শেষ একটি বা দুটি টেস্টে একেবারে প্রাণহীন উইকেট তৈরি করে। কিন্তু যেহেতু এখন প্রতিটা টেস্ট ম্যাচেই একটা পয়েন্ট জেতার ব্যাপার আছে, কাজেই কোনো দলই এই ধরণের ‘ডেড-রাবার’ পিচ তৈরি করবে না। এর ফলে ক্রিকেটের ভালো হচ্ছে না খারাপ সেটা একটা খুব স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ।

ক্রিকেটের সারসত্য একটাই। একটা টেস্ট ম্যাচ তুমি তখনই জিতবে, যখন তোমার বোলাররা কুড়ি উইকেট পাবে। অন্যথায় হাজার রান করলেও, জয় আসবে না। তাই বোলারদের ঠেসান দিতেই বোধহয় আজকাল প্রায় সব জায়গায় ‘স্পোর্টিং’ পিচ তৈরির হিড়িক জন্মেছে। লিখছি বটে স্পোর্টিং, কিন্তু আদতে তো নিজের দলের বোলিং শক্তি অনুযায়ী উইকেট।

এখানেই একটা খুব বড়ো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনেক সময় নিছক সাধারণ মানের বোলারকেও বিশাল বড়ো মাপের কেউকেটা মনে হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ অক্ষর প্যাটেল। এই স্পোর্টিং পিচের হিড়িকেই কিনা কে জানে, আজকাল অনেক টেস্ট কেন্দ্রই নিজেদের স্বাভাবিক চরিত্র খুইয়েছে। আগে মোহালিতে খেলা হলে, পেসাররা হাত চাটতেন।

ব্যাটসম্যানরাও। শক্ত উইকেট। সিম মুভমেন্ট হয়। ভালো ক্যারি রয়েছে। কিন্তু বল পরে ব্যাটেও আসে। স্ট্রোকপ্লের আদর্শ উইকেট। কিন্তু বর্তমানে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্পিনারদের অর্ডারি পিচ। মাদ্রাজে যেমন ম্যাচের দ্বিতীয় দিন থেকেই ধুলো ওড়ে, আজকাল মোহালিতেও তাই।যদি ভারত ছেড়ে একটু দক্ষিণ গোলার্ধে পারি দেই, তবে দেখবো অ্যাডিলেডও একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে। অ্যাডিলেড একসময় ব্যাটসম্যানের স্বর্গরাজ্য ছিল।

কিন্তু, বর্তমানে এমন উইকেট তাঁরা বানায়, সেরা সময়ের লিড্স্ও লজ্জা পেয়ে যাবে। পুরু ঘাসের আস্তরণ এখন অ্যাডিলেড পিচে জলভাত। অস্ট্রেলিয়ায় অবশ্য প্রায় সবকটি টেস্ট কেন্দ্রই এখন ড্রপ ইন উইকেট বানায়, যেহেতু বেশির ভাগ কেন্দ্রই ক্রিকেট ছাড়াও অন্যান্য খেলার জন্যে ব্যবহৃত হয়। কাজেই সেখানে অর্ডারি পিচ বানানো ব্যাপারটা এতটাও অস্বাভাবিক নয়। তবে এমনটা একেবারেই বলছি না যে অর্ডারি পিচ বানানোর প্রবণতা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ আরম্ভ হবার পর শুরু হয়েছে। এ বহু আগে থেকেই ছিল। তবে প্রবণতা ও প্রয়োজনীয়তা, দুইই বৃদ্ধি পেয়েছে চ্যাম্পিয়নশিপ উত্তর।

একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করি। পরিসংখ্যানটি প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দুই ফাইনালিস্টের পরিপ্রেক্ষিতে। ২০১৭র শুরু থেকে ২০১৯ এ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হবার আগে অব্দি ভারতে গড় প্রথম ইনিংস স্কোর ৩৮৫ রানে ৯ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংস স্কোর ৩৩১ রানে ১০ উইকেট, তৃতীয় ইনিংস স্কোর ২০৪ রানে ৮ উইকেট ও চতুর্থ ইনিংস স্কোর ১৪৬ রানে ৬ উইকেট।

এই সময়কালে হওয়া ১১ টেস্টের মধ্যে ৮ টি টেস্টে ফলাফল হয়েছে। ৩টি ড্র। এমনকি শ্রীলঙ্কার মতো দলের বিরুদ্ধেও এসেছে দুটি ড্র। ২০১৯ সালে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হবার পরে ভারতে হওয়া ৯ টেস্টের প্রতিটিতেই ফলাফল হয়েছে। এই সময়ে গড় প্রথম ইনিংস স্কোর ৩৪২ রানে ৯ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংস স্কোর ২৯৯ রানে ৯ উইকেট, তৃতীয় ইনিংস স্কোর ১৯৩ রানে ৯ উইকেট, এবং চতুর্থ ইনিংস স্কোর ১৪৯ রানে ৮ উইকেট।

দেখা যাচ্ছে প্রথম ইনিংস স্কোরের একটা বড়ো ফারাক। প্রতি উইকেটে গড়ের ফারাক প্রায় ৪ রান। আপাতদৃষ্টিতে রান সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, আদতে বড়ো ক্যানভাসে এটা যথেষ্ট বড়ো ফারাক। এবং এর সম্ভাব্য কারণ হিসাবে ম্যাচে ফলাফল লাভ করার জন্যে স্পোর্টিং (পড়ুন ঘূর্ণি) উইকেট বানানোর প্রবণতা।

নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একটু দেখা যাক। একই সময়সীমায়, অর্থাৎ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আগে অবধি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে হওয়া টেস্টের গড় প্রথম ইনিংস স্কোর ২৭৩ রানে ১০ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংস স্কোর ৪১২ রানে ৯ উইকেট, তৃতীয় ইনিংস স্কোর ২৭৭ রানে ৮ উইকেট, ১৮৪ রানে ৬ উইকেট।

এই সময় হওয়া ১৩ টেস্টের ৪ টি ড্র হয়। এবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ সময়ে স্কোরগুলি হলো যথাক্রমে-প্রথম ইনিংস ৩৫২ রানে ১০ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংস ২৯২ রানে ৯ উইকেট, তৃতীয় ইনিংসে ২০৮ রানে ৯ উইকেট, চতুর্থ ইনিংসে ১৩৭ রানে ৪ উইকেট। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তৃতীয় ইনিংসে স্কোরের একটা বিশাল তফাৎ চোখে পড়ছে। এটাও উল্লেখ্য যে এই সময়ে হওয়া ৬ টেস্ট ম্যাচের একটিও ড্র হয়নি।

উইকেট প্রতি গড় ২০১৭ থেকে ২০১৯ এ ৩৫.২৬। ২০১৯ পরবর্তী এই গড় ৩০.৫০। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ পরবর্তী ব্যাটিং গড় যে কমেছে, তা শুধুমাত্র খারাপ ব্যাটিং বা দারুন বোলিংয়ের কারণে নয়। যদি দুই দেশেরই খেলোয়ারবর্গ দেখা যায়, দেখা যাবে যে অনেকেই তখনও খেলতেন যাঁরা এখন খেলছেন।

রাতারাতি কেউ খারাপ ব্যাটসম্যান বা বোলার হয়ে বোধহয় যান না। ফর্মের তারতম্য ঘটতেই পারে। তাই গড়ের এতো ফারাক বোধহয় পিচ এবং কন্ডিশনের ওপরেই বর্তায়। যা বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ পরবর্তীকালেই হয়েছে বলে মনে হয়। কাজেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফলে কনটেক্সট তো এসেছে, কিন্তু পিচের সাধারণ চরিত্র বদলে গেছে। অর্ডারি পিচের গাদি লেগে গেছে। এবং ঠিক সেই কারণেই ব্যাটসম্যানদের লিলিপুট ও বোলারদের গালিভার মনে হচ্ছে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...