তরুণ প্রতিভাকে ঘষেমেজে তৈরি করার জন্য ইউরোপীয় দলগুলোর কাছে বেশ বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান ক্লাব পালমেইরাস। ২০২২ চেক প্রজাতন্ত্রে অনুষ্ঠিত সিইই কাপে এক ঝাঁক তরুণ ফুটবলারকে নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিল দলটি। নিয়মিত একাদশের কয়েকজন না থাকা সত্ত্বেও বেশ দাপটের সাথেই টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছিল তারা।
স্লাভিয়া প্রাগের বিপক্ষে ফাইনালে ২-১ গোলে জিতেছিল পালমেইরাস। আর সেদিন ম্যাচ জেতানো গোল করে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন দলটির আরেক তরুণ তুর্কি। শুধু ম্যাচ জেতানো গোল নয়, পুরো ম্যাচেই তাঁর পারফরম্যান্স নজর কেড়েছে। তিনি থ্যালিস গোমেজ ডি আরাউহো, পালমেইরাসের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।
পুরো টুর্নামেন্টে তিন গোল করে যৌথভাবে গোল্ডেন বুট জিতেছেন থ্যালিস। এছাড়া আসরের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার উঠেছে তাঁর হাতে।
নিজের সহজাত পজিশন ‘নাম্বার টেন’ বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হলেও ভার্সেটাইল ফুটবলার হিসেবেও দুর্দান্ত থ্যালাস। আক্রমনভাগের যেকোনা পজিশনে বিশেষ করে ফলস নাইন এবং রাইট উইংয়ে খেলালেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স পাওয়া যায় তাঁর কাছ থেকে। নিজের প্রিয় বাম পায়ের সাহায্যে কাট করে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ঢুকে পড়তেও দারুণ সিদ্ধহস্ত তিনি।
থ্যালাস বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে বলের উপর পুরো নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতে পারেন। তার লম্বা, সরু পায়ের কারুকাজ পালমেইরাস এবং ব্রাজিলের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় রিভালদোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
ব্রাজিলের অলিতে-গলিতে ফুটবলার পাওয়া যায়; শিশুদের জন্মের পরেই সখ্য গড়ে উঠে ফুটবলের সাথে। সেই সব ক্ষুদে প্রতিভাবানদের যত্ন করে বড় করে তোলার দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করে পালমেইরাস। তাদের ক্লাব থেকে তৈরি হওয়া ফুটবলাররা ক্যারিয়ারের একটা পর্যায়ে ইউরোপীয় ফুটবলে রাজ করে।
অতীতের নামগুলো বাদ-ই থাকুক; এইতো কিছুদিন আগে উদীয়মান মিডফিল্ডার গ্যাব্রিয়েন ভেরন ১০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে পোর্তোতে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া গ্যাব্রিয়েন মেনিমো, দানিলো, জিওভানির মত তরুণেরাও ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোতে পা রাখার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন।
এমনকি ষোল বছর বয়সী অ্যানড্রিক ফেলিপে এবং লুইস গুইলহারমের দিকে নজর আছে বার্সেলোনা রিয়াল মাদ্রিদের মত পরাশক্তিগুলোর।
সম্ভাবনাময়ী তরুণদের শিবিরে এবার নতুন যোগ হয়েছে থ্যালিসের নাম। কিন্তু এই ফুটবলারের আলোতে উঠে আসার পিছনে রয়েছে অন্ধকারচ্ছন্ন একটি গল্প। মাত্র চার বছর বয়সে থ্যালিস আরাউহোর বাবা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। পরিবারে নেমে আসে দু:খ আর সাথে করে নিয়ে আসে দরিদ্রতার অভিশাপ। পরবর্তীতে ১১ বছর বয়সে বাধ্য হয়ে ফুটবল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন থ্যালাস।
সংসার চালানোর কাজে মাকে সাহায্য করতে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এই কিশোর৷ কিন্তু বাদ সাধেন স্বয়ং তাঁর মা। ছেলেকে স্বপ্নপূরণের পথে অবিচল থাকতে বলেন তিনি। শেষপর্যন্ত ২০২১ সালে পালমেইরাসে জায়গা পাওয়ার মধ্য দিয়ে মা এবং সন্তানের স্বপ্ন আকাশে ডানা মেলে।
সেসময় ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগে দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলতেন থ্যালিস। সেখানকার ক্লাব ডি রেগাতাস ব্রাজিল দলের যুব একাডেমিতে ছিলেন তিনি। এসময় তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় পালমেইরাসের স্কাউটরা। বিশেষ করে বল পায়ে তাঁর নিয়ন্ত্রণ আর ডিফেন্স চেরা পাসগুলো দেখে সাও পাওলোতে নিয়ে আসা হয় তাকে৷
পালমেইরাসের অনূর্ধ্ব ১৭ দলে নিজের প্রথম মৌসুমে সাত গোল করেন থ্যালাস। পরে আবার ১১ ম্যাচে আট গোল করেন। শুধুমাত্র ২০২২ সালে ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব ১৭ দলের বার্ষিক টুর্নামেন্ট এফএএম কাপে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন থ্যালিস। আবার অনূর্ধ্ব ১৭ ব্রাজিলিয়ান কাপে সাত গোল করে দলের শিরোপা জয়ে অবদান রাখেন।
থ্যালিস আরাউহোর মাঝে রিভালদোর ছায়া দেখা গেলেও তিনি যে রিভালদো হবেন না সেটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। হয়তো তিনি আরো বড় কিছু হবেন, হয়তো রিভালদোর চেয়ে আরো কম। কিন্তু যে প্রতিভা নিয়ে ফুটবল জগতে এসেছেন থ্যালাস সেটি ধরে রাখতে পারলে পরবর্তী বিশ্বের সুপারস্টার হতে পারবেন তিনি।
থ্যালিসের প্রাথমিক স্বপ্ন পালমেইরাসের মূল দলে খেলার সুযোগ পাওয়া। এছাড়া ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে চান তিনি। আপাতত তাই পালমেইরাসের একাডেমিতে থেকে সেসব লক্ষ্য পূরণে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এই ব্রাজিলিয়ান কিশোর।