বিস্ময়কর সেই বালক অধিনায়ক

২০০৩ বিশ্বকাপ তখন মাত্রই শেষ হয়েছে। শেষ হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকানদের আরেকটি দু:স্বপ্ন। ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকার (সিএসএ) নির্বাচকরা তখন একটা জুয়া খেলে বসেন। অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় মাত্র ২২ বছর বয়সী গ্রায়েম স্মিথ। ২০০০ সালে যিনি অনূর্ধ্ব- ১৯ বিশ্বকাপ খেলেছেন, মাত্র তিন বছরের মাথায় তিনি অধিনায়ক। এখানেই শেষ নয় তিনি এতটাই তরুণ যে এর আগে খেলেছেন মাত্র আটটা টেস্ট। ফাটকা মনে হলেও কার্যত সেই সিদ্ধান্তই পাল্টে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটকে।

টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তিনি যত রান করেছেন, সেটা আর কেউই করতে পারেননি। অথচ, একদম তারুণ্যে যখন অধিনায়কত্ব পান তখন তিনি এই চাপটা সামলাতে পারবেন কি না – সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনা ছিল – যদিও তাতে পুরোপুরি পাশ করে যান সময়ের সাথে সাথে।

অধিনায়ক হিসেবে শুরুটা ঝড়ো গতিতে হয়। অনেক কানাঘুষার পর সেই চাপ উৎরে সাফল্য পান। সর্বকালের সেরা প্রোটিয়া দলটা তাঁর নেতৃত্বেই খেলেছে। চোকার অপবাদ ঘুচিয়ে বিশ্বকাপটা জিততে পারেননি, কিন্তু যে কোনো ফরম্যাটে তিনি দলকে করে গেছেন বিশ্বসেরা। তিনিই ইতিহাসের একমাত্র অধিনায়ক যিনি ১০০ টি টেস্ট দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এই দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক হিসেবে ৪৭.৮৩ গড়ে করেন ৮৬৫৯ রান! বোঝাই যাচ্ছে ক্যারিয়ারের বড় একটা সময়ই তিনি খেলেছেন অধিনায়ক হিসেবে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা অ্যালান বোর্ডারের রান ৬৬২৩। মানে তিনি, অর্থাৎ গ্রায়েম স্মিথ এখানে দুই হাজার রানের ব্যবধানে এগিয়ে।

যতটা ভাল অধিনায়ক ছিলেন, তাঁর চেয়েও ছিলেন দারুণ একজন ওপেনার। টেস্টে ৪৮-এর ওপর গড় নিয়ে ২৭ টি সেঞ্চুরি ও ৩৮ টি হাফ সেঞ্চুরিতে করে গেছেন নয় হাজারের ওপর রান। অধিনায়ক হওয়ার পর তিনি এই ব্যাট দিয়েই সমালোচনার জবাব দেন। তবে, তার অধিনায়কত্ব আর ব্যাটিং – দু’টোকে ঠিক আলাদা করা যায় না। কারণ, স্রেফ ব্যাটসম্যান পরিচয়ে তিনি খেলেছেন সামান্য ক’দিন।

২০০৩ সালের ইংল্যান্ড সফরে করেন টানা দুই ডাবল সেঞ্চুরি। দল হারলেও, গ্রায়েম স্মিথের অধিনায়কত্বের স্টাইলটা পরিস্কার হয়ে যায়। তিনি ছিলেন ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’। টপ অর্ডারে একের পর এক বড় ইনিংস খেলতে থাকেন তিনি, সেটা সব ফরম্যাটেই।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে ৪৩৪ রান তাড়া করে জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই ম্যাচের নায়ক হার্শেল গিবস হলেও স্মিথ ৫৫ বলে করেন ৯০ রান। সেই সিরিজে ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়াকে ৩-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজেও হারায় প্রোটিয়াররা। যদিও, এরপরের বছরই বাজে ভাবে সেমিফাইনাল থেকে বিশ্বকাপ স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয় দক্ষিণ আফ্রিকার। যদিও, এরপরই ভারতকে দেশের মাটিতে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে নতুন শুরু করে গ্রায়েম স্মিথের দল।

টেস্টে তখন গ্রায়েম স্মিথের দক্ষিণ আফ্রিকা অজেয় এক দল। পাকিস্তানকে হারানোর পর স্মিথ বাংলাদেশে এসে ওপেনিংয়ে জুটির বিশ্বরেকর্ড গড়েন। নিল ম্যাকেঞ্জিকে সাথে নিয়ে যোগ করেন ৪১৫ রান। এরপর ২০০৮-এর শেষে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক এক সিরিজ জিতে নেন।

গ্রায়েম স্মিথের অধিনায়কত্বের পূর্ণতা আসে ২০১২ সালে। ইংল্যান্ডকে ২-০ ব্যবধানে হারানোর পর দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট র‌্যাংকিংয়ের চূড়ায় চলে আসে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে গিয়ে খেললেও একটা টেস্টও হারেনি প্রোটিয়ারা। সিরিজ জেতে ১০০ ব্যবধানে।

স্মিথ ছিলেন চতুর্থ ইনিংসের জিনিয়াস। দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি বরাবরই জ্বলে উঠতেন। চতুর্থ ইনিংসে তাঁর ব্যাটিং গড় ৫৬১.৯৬। আর এর মধ্যে যে ম্যাচগুলোতে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে তাঁতে তিনি ব্যাট করেছেন প্রায় ৮৮ গড় নিয়ে।

টানা সাফল্য পাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল স্মিথের। তবে, বাজে সময়ও এসেছিল। তবে, সেটা খুব বেশিদিন স্থায়ী হতে দেননি। ২০১৪ সালে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ হারার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন স্মিথ! তখন বয়স মাত্র ৩৩, ঘরোয়া ক্রিকেটেও আর খুব বেশি থাকেননি।

যাওয়ার আগে অধিনায়ক হিসেবে করে যান ১৫ টি টেস্ট সেঞ্চুরি। এটাও বিশ্ব রেকর্ড!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link