কালের পরিক্রমায় ফুটবলে বদলেছে অনেক কিছু। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে খেলার ফরমেশনে, অর্থাৎ খেলোয়াড় সাজানোতে। সেই সাথে অনেক খেলোয়াড়ের যেমন মূল দলে দুয়ার খুলছে। তেমনই দল থেকে ছিটকে পড়ছেন অনেক তারকা ফুটবলার।
সাবেক বিশ্বকাপ জয়ী জার্মান কোচ জোয়াকিম লো তো বলেই বসেছেন, এখন প্লে-মেকার নির্ভর ফুটবল নেই। বরং এখন তিনি মনে করেন খেলায় ৪,৫,৬ নম্বর পজিশন বেশি দরকার। তাহলে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, এখনকার সিস্টেমে সেই প্লে মেকারদের কিভাবে কাজে লাগান যায়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের একটু না, বেশ পেছনে যেতে হবে। ইতিহাস বলে ১৯৫০ সালে ব্রাজিলিয়ানরা এই পদ্ধতি প্রথম কাজে লাগায়। আমরা কথা বলছি ম্যাজিক রেক্ট্যাংগল ৪-২-২-২ ফরমেশন নিয়ে। ১৯৫০ সালের সেই দলে ফ্লভিও কস্তা জোর দেন নিয়মিত আক্রমনের ধারা রক্ষার দিকে।
পাশাপাশি খেয়াল রাখেন যেন দলের রক্ষণ দূর্বল না হয়। ১৯৫০-৬০ সময়কালে ফরাসি ম্যানেজার আলবার্ত বাতেউক্স লিগ ওয়ানে এই ফরমেশনের বদৌলতেই রেইমস এবং সেন্ট এতিয়েনের ডাগআউটে বসে জয় করেন ৮ শিরোপা। এর বাইরে দক্ষিণ আমেরিকায় এই ফরমেশনের বেশ বিস্তৃতি দেখা গেছে সে সময়ে। আবারো ৪-২-২-২ ইউরোপীয় ফুটবলে ফিরে আসে ১৯৮৪ সালে ফ্রান্সের ইউরো জয়ের মধ্য দিয়ে।
অনেক তো হলো ইতিহাস নিয়ে বকবকানি। এবার একটু কথা বলি ফরমেশন টা কেমন। এর ব্যাক লাইন অন্য যেকোনো ফরমেশনের চার জন রক্ষণের মতোই। এখানে বলে রাখা ভাল এই ফরমেশনে ফুল ব্যাক দের আক্রমনে প্রশস্ততা দিতেও কাজে লাগানো যাবে। তবে মধ্যমাঠ টা একটু অদ্ভুত।
চার জনের মাঝ মাঠ টা দুভাগে বিভক্ত। একভাগ থাকবে নিচে। যেখানে থাকবে এক জোড়া রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার। মূলত রদ্রি বা দি পলের মতো ডবল পিভট। আরেক ভাগ সমন্বয় করবে আক্রমন ভাগের সাথে। যেখানে থাকবেন দুজন নম্বর দশ পজিশিনের আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডার। কিছুটা কাকা বা ওজিলের মতো। ছোট্ট করে মনে করিয়ে দেই আধুনিক ফুটবলে কিন্তু ১০ নম্বর পজিশন প্রায় বিলুপ্তির পথে। সবশেষ আক্রমন ভাগের দুজন সাধারণ ৪-৪-২ এর মতোই জোড়া স্ট্রাইকার থাকবে।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, এর সুবিধা টা কি? এই ফরমেশন আধুনিক ফুটবলের মূল চাহিদা ব্যালান্স রক্ষায় অবদান রাখে। যেখানে কোন ভাবে সেন্টার ব্যাক যদি অবস্থান টলেও যায় তাহলেও থাকবে জোড়া পিভট। আবার খেলায় উইং এর কাজ টা ফুল ব্যাকরাও রক্ষনের সাথে সাথে করতে পারবে। অন্য দিকে প্লে মেকাররা মাঝ মাঠের কর্তা হলেও আক্রমন ভাগের নিয়মিত সাহায্যে থাকবেন সদা তৎপর। এতে আক্রমন রক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই সমান নিয়ন্ত্রন রাখা সম্ভব হয়।
এখন একটা কথা বলাই যায় আধুনিক ফুটবলে এত তত্ত্বের সত্যতা কই? ম্যানুয়াল পেলেগ্রিনি ম্যানচেস্টার সিটি, ভিয়ারিয়াল এবং রিয়াল বেতিসে এই ফরমেশন চালান। যার সুবাদে সিটিকে জেতান লিগ শিরোপা আর বেতিস কে জেতান কোপা দেল রে। কখনো আবার ৪-৩-২-১ বা ৪-৪-২ কে বদলে করতেন ৪-২-২-২।
অন্যদিকে অস্ট্রিয়ান রালফ হ্যাসেনহুটেল এই ফরমেশনে আর বি লাইপজিগ কে তাদের অভিষেকেই করেন দ্বিতীয়। তবে এর আগেও লাইপজিগ এসেছিল আলোতে যখন রালফ র্যাংগনিক তাদের এই একই ফরমেশনে জেতান ডিএফবি পোকাল।
তবে এই ফরমেশন তিনি আগেও খাটিয়ে ছিলেন। যখন তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ ছিলেন। মজার একটা তথ্য দেই। র্যাংগনিক এর সময়ে রেডডেভিল আর পেলেগ্রিনির সময়ে মাদ্রিদে একজন খেলোয়াড় দু’দফা এই সিস্টেমে খেলেছেন। কে আন্দাজ করতে পারবেন? তিনি হচ্ছেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোল স্কোরার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
এখন এই ফরমেশনের একটা মজার দিক উল্লেখ করি। এই ফরমেশন বদলে ৪-৪-২ বা ৪-৩-২-১ এ সহজেই নেয়া যায়। যেটা পেলেগ্রিনি তাঁর ম্যানেজার ক্যারিয়ারে করে সাফল্য পান। তবে এর বাইরেও এই ফরমেশন ৪-৩-৩ নেয়া সম্ভব। কিন্তু সেইটা কিভাবে? প্যালেগ্রিনি এর সাথে বদলে ছিলেন ৪-৪-২।
এদিকে স্কালোনি তাঁর সবশেষ কোপা জয়ের ফাইনালে ৪-৪-২ কে নিয়েছিলেন ৪-৩-৩ এ। যেখানে দ্বিতীয় স্ট্রাইকার জীবন্ত কিংবদন্তি মেসি ফলস নাইন আর আলভারেজ উইং এ আসে। আরেক পাশে এসে পড়ে মারিয়া। এর বাইরেও এই ফরমেশনে উইং ব্যাকদের শুরুর একাদশে খেলিয়ে আক্রমনাত্মক গেম প্লে করা সম্ভব। আবার যে প্লে মেকিং পজিশন সেখানে শেষার্ধে লেফট বা রাইট মিডফিল্ড কিংবা উইং যোগ করে খেলাকে গতিময়তা দান করা যেতে পারে।
এখন শেষ একটা রহস্যের জট রয়ে গেছে। আধুনিক ফুটবল এখানে কিভাবে আলাদা করে লাভবান হবে? আধুনিক ফুটবলে প্লে মেকার আর ডিফেন্সিভ মিড কে তাদের স্ব পজিশনে খেলানোর সুযোগ করে দেয়া ফরমেশন এটি। কিন্তু যেহেতু এত কিছুর পরেও রক্ষন ভাগ একই রয়ে গেছে। সেখানে ডেভিড ডে গিয়ার মতো স্টপারদের কিপিংয়ে সহজেই খেলানো যায়। এত সব কিছুর পরেও খেলার ভারসাম্য কিন্তু একদমই নষ্ট হয়না।
তাহলে বলাই যায় যে আধুনিক ফুটবল এবং পুরোনো খেলার ধরনের এক চমৎকার মেল্বন্ধন এই ৪-২-২-২। আবার খেলোয়াড় কে তাঁর স্বকিয়তা রক্ষায়ও সাহায্য করে এই ফরমেশন।ফলে ফুটবল হয়ে ওঠে আরও স্থবির, আরও কাব্যিক।