টেস্ট ক্রিকেট মানেই ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সম্মান, সর্বোচ্চ মর্যাদার লড়াই। টেস্ট ইতিহাসের সেরা বোলারদের নাম নিলে যে নাম গুলো আসবে তার মধ্যে অন্যতম মুত্তিয়া মুরালিধরন, রিচার্ড হ্যাডলি, কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ, শেন ওয়ার্ন সহ আরো অনেকেই রয়েছেন এই তালিকায়। যারা নিজেদের সময়ে নিজের বোলিং ‘জাদুতে’ নাকানিচুবানি খাইয়েছেন ব্যাটসম্যানদের।
বর্তমান ব্যাটিং সহায়ক উইকেটগুলো যেনো বোলারদের জন্য মৃত্যুফাঁদ। অভিজ্ঞ বোলাররাই যেখানে উইকেট নিতে ঘাম ঝরায় সেখানে নব্য বোলারদের জন্য তো রাস্তা টা বেশ কঠিন। তবুও কিছু বোলার এখনো প্রতিপক্ষের জন্য ত্রাস হয়ে ২২ গজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। স্টুয়ার্ড ব্রড, জেমস অ্যান্ডারসন কিংবা মিশেল স্টার্কদের নিয়ে বেশ মাতামাতি হলেও কেউ কেউ আছেন নীরবেই নিজের কাজ করে যাচ্ছেন সেরা হবার।
বলছিলাম টেস্ট ক্রিকেটে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ‘আন্ডাররেটেড’ বোলার নিল ওয়াগনারের কথা। ১৯৮৬ সালের ১৩ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম তাঁর। জন্মভূমি আফ্রিকায় হলেও ২২ গজ মাতাচ্ছেন নিউজিল্যান্ডের হয়ে। বর্তমান সময়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের জন্য এক চিন্তার নাম এই নিল ওয়াগনার। বাম হাতে বল করলেও তিনি ব্যাট করেন ডান হাতে।
২০০৫ সালে নর্দান্সের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে পা রাখেন নিল। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়েই স্বপ্ন দেখেছিলেন। দেশটির অ্যাকাডেমি দলের হয়ে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে সফরও করেন। দু’বার টেস্ট দলের দ্বাদশ ব্যক্তিও ছিলেন। কিন্তু, সম্পর্কটা আর এর আগে গড়ায়নি।
তিন বছর আফ্রিকার ঘরোয়া লিগে খেললেও ২০০৮ সালে সবকিছু ছেড়ে পাড়ি দেন নিউজিল্যান্ডে। সেখানেই শুরু করেন নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেবার কাজ। ২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ইমার্জিং প্লেয়ার একাদশে জায়গা পান এই পেসার।
৬ এপ্রিল ২০১১, ওয়েলিংটনের বিপক্ষে এক ওভারে প্রথম চার বলে চার উইকেট নিয়ে নির্বাচকদের নজরকাড়েন তিনি। সেই ওভারে ৫ উইকেট সহ ইনিংসে ৩৬ রানের বিনিময়ে নেন ৬ উইকেট। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এক ওভারে ৫ উইকেট শিকারের রেকর্ড একমাত্র আছে এই নিল ওয়াগনারের। আজ পর্যন্ত তার এই রেকর্ডে ভাগ বসাতে পারেননি কেউই।
এরপর অবশ্য খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। পরের বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ডাক পান জাতীয় দলে। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ১৯ উইকেট নিয়ে নিজেকে জানান দেন নিল। ভারতের বিপক্ষেও ম্যাচে ৮ উইকেট শিকার করে হন ম্যান অব দ্যা ম্যাচ। দূর্দান্ত ফর্মে থাকার পরেও নিয়মিত হতে পারছিলেন না দলে। ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদিদের ভিড়ে অনেকটাই পেছনে ছিলেন তিনি।
দূর্দান্ত পারফরম করেও দলে থিতু হতে পারছিলেন না তিনি। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১ম ইনিংসে ৬ উইকেট সহ ম্যাচে ৭ উইকেট নিয়ে দলে নিজের জায়গা অনেকটাই নিশ্চিত করেন। এরপর ২০১৬ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে ১১ উইকেট নিয়ে ম্যান অব সিরিজের পুরষ্কার জিতেন তিনি। একই বছর নিজ জন্মভূমি আফ্রিকার বিপক্ষেও শিকার করেন ‘ফাইফার’।
২০১৭ সালে টিম সাউদির ইনজুরিতে প্রথমবারের মতো ট্রেন্ট বোল্টের সাথে দ্বিতীয় পেসার হিসেবে সুযোগ পান নিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র দুই সেশনেই ৩৯ রানে ৭ উইকেট নিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন তিনি। এখন পর্যন্ত এটিই তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের বেস্ট ফিগার। সেবছর ক্রিকইনফোর ‘টিম অব দ্যা ইয়ারে’ নির্বাচিত হন নিল। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। টেস্ট একাদশে পাকাপাকি ভাবেই নিজের জায়গা করে নেন তিনি।
২০১৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে ক্যারিয়ারের ১৫০ তম উইকেট শিকার করেন তিনি। এক বছর না যেতেই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শিকার করেন ক্যারিয়ারের ২০০ তম টেস্ট উইকেট। আইসিসি টেস্ট বোলিং র্যাংকিংয়ে উঠে আসেন দুই নম্বরে। গেলো অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড সিরিজেও নিজের ভয়ংকর বাউন্স আর গতিতে নাকানিচুবানি খাইয়েছেন স্মিথ-ওয়েডদের।
সাদা পোশাকে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র সুযোগ পাননি নিউজিল্যান্ডের হয়ে রঙিন পোশাকে। হয়তো সুযোগ পেলে সাদা বলেও নিজেকে মেলে ধরতেন তিনি। উইকেট সংখ্যা কিংবা ম্যাচ বিচারে টেস্ট ক্রিকেটের গ্রেট দের ধরতে না পারলেও এই প্রজন্মের টেস্ট ক্রিকেটের সেরা বোলারদের তালিকায় তিনি হয়তো তিনি জায়গা করে নিবেন নিজের অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়েই।
ব্রড-অ্যান্ডারসনদের ছুঁতে না পারলেও নিজেকে হয়তো নিয়ে যাবেন অনেক উপরে৷ ক্যারিয়ার শেষে হয়তো আফসোস করতেই পারেন রঙিন পোশাকে কি তিনি আসলেই ব্যর্থ হতেন? নাকি পর্যাপ্ত সুযোগে অভাবে চাপা পড়বেন অনেকের ভিড়ে!