২০০০ এর পরবর্তী সময়ে উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের শুরুটা করেছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। আর উপমহাদেশে সেটির শুরু পাকিস্তানি ওপেনার কামরান আকমলের ব্যাটে। চোখ ধাঁধানো পুল শটে বলকে নিমিষেই বাউন্ডারি ছাড়া করতেন তিনি। মার কাটারি ব্যাটিংয়ে নিজের জায়গা পাঁকা করেছিলেন অল্পতেই।
তবে উইকেটকিপিংয়ে কিছু দৃষ্টিকটু মিস যেন আকমলকে সবসময়ই রেখেছিলো সমালোচনার বৃত্তে। আর এই উইকেটকিপিংয়ের জন্যই পরবর্তীতে জায়গা হারান সাবেক পাকিস্তানি অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদের কাছে। ফিক্সিং ইস্যু, উইকেটকিপিংয়ে সহজ ভুল সব মিলিয়ে লম্বা রেসের ঘোড়া থেকে আকমলের ক্যারিয়ার থমকে গেছে আক্ষেপ আর হতাশায়।
গলি ক্রিকেটে টেনিস বল দিয়েই ক্যারিয়ার শুরু আকমলের। দুই ছোট ভাই আর বাবা-চাচাদের সহযোগিতায় ক্রিকেটে পথচলা। ক্রিকেট ছাড়া ঘুড়ি উড়ানোর প্রচন্ড শখ ছিলো তাঁর। ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক থাকায় বাবা ভর্তি করে দেন ক্লাবে। বাবা-চাচাদের সাথে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করতেন আকমল। একদিন পাড়ার ছেলেদের ক্রিকেট সরঞ্জাম নিয়ে যেতে দেখায় উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাচ্ছেন তারা।
জানতে পারলেন অনূর্ধ্ব ১৫ দলের জন্য ট্রায়াল দিতে লাহোর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠে যাচ্ছে। তখন দোকান থেকে আকমলকে বাড়ি পাঠানো হলো লোহার কিছু জিনিস আনতে। আর সেই সুযোগে গ্লাভস, ব্যাট, প্যাড যেখানে যাই পেয়েছেন নিয়ে পৌঁছে যান স্টেডিয়ামে। এরপর সেখানে অনূর্ধ্ব ১৫ দলে টিকে যান আকমল। এখান থেকেই শুরু আকমলের ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
ট্রায়ালে ব্যাটিংয়ের সময় একদিন পাকিস্তান ক্রিকেট গ্রেট ইমরান খান আকমলের ব্যাটিং দেখে তার বাবাকে বলেছিলেন, ‘ওকে ক্রিকেট খেলতে দিয়েন। পরিশ্রম করলে আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।’
ক্যারিয়ারের শুরুতে কামরান ছিলেন একজন পার্ট টাইম উইকেটকিপার। গলি ক্রিকেটেও তিনি সবসময়ই চাইতেন কিপিং করতে। ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত লমবার্ড অনূর্ধ্ব ১৫ চ্যালেঞ্জ কাপে সুযোগ পান কামরান। তখন মাত্র ১৩ বছর বয়স! ওই টুর্নামেন্টে শোয়েব মালিক, হাসান রাজা, তৌফিক উমর, মোহাম্মদ কাইফরাও খেলেছিলেন। এরপর ১৯৯৭ সালে ১৫ বছর বয়সেই পাকিস্তান অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলার সুযোগ পান তিনি। হাসান রাজা ছাড়া তিনিই ছিলেন দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ খেলোয়াড়। ওই দলে ছিলেন লেগ স্পিনার ইমরান তাহির (বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলেন)।
একই বছর ১৯৯৭ সালেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে লাহোরের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন কামরান আকমল। ওই দলে আব্দুল রাজ্জাক, ইমরান তাহির, সালিম এলাহি সহ ছিলেন আরো অনেকে। অবশ্য অভিষেকেই ডাক মারেন কামরান!
সেখান থেকে মাত্র ২০ বছর বয়সে ২০০২ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পান তিনি। আর অভিষেকে ইনিংসেও রেমন্ড প্রাইসের বলে বোল্ড হয়ে শূন্য রানে ফিরেন কামরান! পরের ইনিংসে ৩৮ রান করলেও ধরা পড়েন সেই প্রাইসের কাছেই। দ্বিতীয় টেস্টেই মেইডেন ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন তিনি।
একই সিরিজে অভিষিক্ত হন ওয়ানডেতেও। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা তখন বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এর উপর উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে লড়াইটা যেনো তারও দ্বিগুন। অবশ্য রশিদ লতিফ, মঈন খানদের বাজে পারফরম্যান্সে তাঁদের টপকে জাতীয় দলে নিজের জায়গাটা পাঁকা করেছিলেন কামরান।
সুযোগ পেলেও ক্যারিয়ারের প্রথম তিন বছর টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই ছিলেন যথেষ্ট সাদামাটা। প্রথম ৯ টেস্টে ১ ফিফটিতে করেছিলেন মোটে ২২৫ রান! আর ১৩ ওয়ানডেতে করেছিলেন মাত্র ১৬৭ রান, দেখা পাননি কোনো ফিফটি কিংবা সেঞ্চুরির! অবশ্য দলের নিয়মিত মুখ তখনো হয়ে উঠতে পারেননি তিনি, ছিলেন আসা যাওয়ার মাঝেই।
২০০৫ সালে ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ক্যারিয়ারে মেইডেন টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পান কামরান। ১০৯ রানের অসাধারণ এক ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন দলকে। পরবর্তীতে ওই বছর ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি।
এরপরই আবারো রান খরায় ভুগছিলেন তিনি। টেস্ট কিংবা ওয়ানডে কোনো ফরম্যাটেই বড় স্কোর করতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে ওই বছরে খেলা নিজের শেষ টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ১৫৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন কামরান। ওই সিরিজে ওয়ানডেতেও টানা দুই ম্যাচে দু’টি সেঞ্চুরি করেন তিনি! বনে যান দলের গুরুত্বপূর্ণ মুখ। ওয়ানডের প্রথম তিন ফিফটিকেই তিনি রূপ দিয়েছিলেন সেঞ্চুরিতে।
২০০৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কিংস্টন টেস্টে ৯ ক্যাচ ধরে এক ম্যাচে পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ ক্যাচ শিকারে যৌথভাবে রশিদ লতিফের পাশে নাম লেখান। ১৯৯৪ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৯ ক্যাচ ধরেন লতিফ।
তখন দলের নিয়মিত মুখ কামরান। ২০০৫-০৬ এর মাঝামাঝি সময়ে ৬ মাসের ব্যবধানে ৬টি সেঞ্চুরি করেন তিনি! ২০০৬ সালে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামেই ভারতের বিপক্ষে টেস্টে আবারো সেঞ্চুরি করেন। ৮১ বলে ওই সেঞ্চুরির পথে ওই সময়ে উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন তিনি। পরের টেস্টে ফিফটি সহ শেষ টেস্টে জুড়ে দেন আরেক সেঞ্চুরি!
দুই সেঞ্চুরি আর এক ফিফটিতে ওই সিরিজে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন কামরান। এরপর শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৩৯ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে তখন চরম বিপাকে পাকিস্তান। সেখান থেকে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে দলকে খাদের কিনারা থেকে তুলেন কামরান। ওই টেস্টে ৩৪১ রানের বিশাল জয়ে সিরিজ জিতে নেয় স্বাগতিক পাকিস্তান।
তবে এরপরই সাদা পোশাকে লম্বা সময় ধরেই ছিলেন অফ ফর্মে। ওই বছরের আগস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি তে অভিষিক্ত হন তিনি। ওয়ানডেতেও ছিলেন চরম বাজে ফর্মে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে বেশ কিছু ক্যাচ মিসে দলকে ভুগিয়েওছিলেন বেশ! এরপর ওই বছরের শেষ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটির দেখা পান তিনি।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করেন কামরান। চরম অধারাবাহিকতার মাঝে ২-১ ম্যাচে বড় ইনিংস খেলে আবারো নিজের জায়গা দলে পাঁকা করতেন। এরপর ইনজুরিতে বেশ কিছু সময় ছিলেন দলের বাইরে। বাজে কিপিংয়ের কারণে ২০০৮ এশিয়া কাপেও বাদ পড়েন তিনি।
ততদিনে ঘরোয়া ক্রিকেটে তরুন উইকেটকিপার ব্যাটার হিসেবে বেশ যশ কামিয়েছিলেন সরফরাজ আহমেদ। অনূর্ধ্ব ১৯ দলে দুর্দান্ত পারফরম করে সরফরাজ ছিলেন নির্বাচকদের নজরে। ওই বছরই ওয়ানডেতে সরফরাজের কাছে জায়গা হারান কামরান। টেস্টেও হয়ে পড়েন অনিয়মিত।
২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। উইকেটকিপিং নিয়ে ক্যারিয়ারে বহুবার সমালোচনার মুখে পড়েন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে উইকেটের পেছনে বাজে পারফরম্যান্সের পর সাংবাদিক সহ সাবেক ক্রিকেটাররাও তাঁর দলে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। ওই সফরের পর ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে বেশ কয়েক ম্যাচে ক্যাচ সহ স্টাম্পিং মিস করেন তিনি! ব্যাকআপ কিপার জুলকারনাইন হায়দার থাকা সত্ত্বেও আকমলকেই একাদশে রাখার সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক সালমান বাট।
ওই বছরই টেস্টে সহকারী অধিনায়কের দায়িত্ব পেলেও স্পট ফিক্সিং ইস্যুতে দায়িত্ব হারান তিনি। ২০০৯-১০ অস্ট্রেলিয়া সফরে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার এক ইনিংসে চারটি ক্যাচ ছাড়েন কামরান! তাঁর দেওয়া সুযোগে ১৩৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংস উপহার দেন হাসি। নবম উইকেটে পিটার সিডলের সাথে গড়েন ১৩৩ রানের জুটি! ওই ম্যাচে ৩৬ রানে হারে পাকিস্তান! পরবর্তীতে অনুসন্ধানে জানা যায় পেসার রানা নাভেদের সাথে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত ছিলেন আকমল। পরের সিরিজেই বাদ পড়েন দল থেকে।
এরপর ইনজুরি আর ফিক্সিং ইস্যুতে আইসিসির তদন্তের কারণে দলের বাইরে ছিলেন তিনি। ২০১০ সালের লর্ডস টেস্টে সালমান বাট, মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফদের সাথে ফিক্সিং ইস্যুতে আবারো নাম আসে আকমলের! তবে পরবর্তীতে আইসিসির তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হন তিনি।
টেস্ট ক্যারিয়ারে অবশ্য আর খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি কামরানের। ২০১০ সালের পর আর সুযোগ পাননি সাদা পোশাকে। ৫৩ টেস্টে ৬ সেঞ্চুরি আর ১২ ফিফটিতে মাত্র ৩১ গড়ে করেছেন ২৬৪৮ রান। তবে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে খেলেছিলেন আরো বছর দুয়েক। ২০১১ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে রস টেলরের সহজ দুই ক্যাচ ছেড়ে দেন তিনি! জীবন পেয়ে ওই ম্যাচে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিও করেন রস।
জাতীয় দলে আসা যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন কামরান। ২০১৩ সালের পর চার বছর ছিলেন ওয়ানডে দলের বাইরে। ওই বছর ১৩ ম্যাচে মাত্র ১৮ গড়ে ২৩৮ রান করার পর বাজে পারফরম্যান্সের কারণে বাদ পড়েন তিনি। টি-টোয়েন্টিতেও আর নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি এই ওপেনার।
তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম করে ২০১৭ সালে কামরান আকমল আবারো জাতীয় দলে ফিরেন। ওই বছর ৪ টি-টোয়েন্টি আর ৩ ওয়ানডেতে সুযোগ পেলেও বাজে পারফরম্যান্সে আবারো বাদ পড়েন দল থেকে। এরপর আর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি এই ব্যাটার। ১৫৭ ওয়ানডেতে মাত্র ২৬ গড়ে করেছেন ৩২৩৬ রান। ৫ সেঞ্চুরি ছাড়া আছে মাত্র ১০টি ফিফটি। অপরদিকে, ৫৮ টি-টোয়েন্টিতে ৫ ফিফটিতে ১২০ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৯৮৭ রান।