ফুটবল ইতিহাসে যখন নম্বরযুক্ত জার্সির ব্যবহার শুরু হয়, শুধুমাত্র মাঠে খেলোয়াড়দের পজিশন নির্দেশক হিসেবেই তখন ব্যবহৃত হত এই সংখ্যাগুলো। সে সময় খেলোয়াড়দের অবস্থান অনুযায়ী এক নম্বর জার্সি বরাদ্দ থাকত গোলরক্ষকের জন্য, তারপর ধারাক্রম অনুসারে রক্ষণভাগ, মধ্যভাগ ও আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের জার্সি নম্বর ঠিক করা হত।
সে হিসেবে দলের স্ট্রাইকারদের মধ্যেই দশ নম্বর জার্সি নির্ধারিত হওয়ার কথা। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দলের মধ্যভাগের যে খেলোয়াড়টি উপরে উঠে খেলতেন, তাঁরাই এই জার্সি পরিধান করতেন। কালের পরিক্রমায় এই দশ নম্বর জার্সির গুরুত্ব এখন আর শুধু দুটো অঙ্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। পেলে-ম্যারাডোনা থেকে শুরু করে হালের মেসি-নেইমারদের হাত ধরে ১০ নম্বর জার্সিটি পেয়েছে আলাদা মহিমা।
ফুটবল বিশ্বে সর্বপ্রথম নম্বরযুক্ত জার্সির ব্যবহার শুরু হয় উনিশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে। খেলোয়াড় শনাক্তকরণ ও পজিশন নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যেই মূলত এ নম্বরগুলোর ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ১৯১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া লিগে সিডনি লাইকহার্ড ও এইচএমএস পাওয়ারফুলের মধ্যকার এক ম্যাচে প্রথমবারের মতো জার্সি নম্বর ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম দল হিসেবে আর্জেন্টিনায় ও পরের বছরে যুক্তরাষ্ট্রে এটির প্রচলন হয়। আর ইউরোপে প্রথমবার জার্সি নম্বরের সূচনা হয় ইংলিশদের হাত ধরে।
জার্সি নম্বর নির্ধারণে একটি বিষয়ের প্রভাব স্পষ্ট। আর সেটি হল দলের ফর্মেশন। ফুটবল ইতিহাসের প্রারম্ভে ১-১-৮ এ ফর্মেশনটি ব্যবহৃত হত। বোঝাই যাচ্ছে- ‘বল যেখানে, সবাই সেখানে’- এ নীতিতে খেলা চলতো তখন! তারপর থেকে সময় যতই গড়িয়েছে, ততই পরিবর্তিত হয়েছে খেলার ধরন, বেড়েছে ফুটবল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের চর্চা। ফলশ্রুতিতে ১-২-৭ ও ২-২-৬ এর মতো ফর্মেশনগুলোর উদ্ভাবন হয়েছে। তবে নম্বরযুক্ত জার্সির ব্যবহার যখন শুরু হয়েছিল, ২-৩-৫ ফর্মেশনের ব্যবহার তখন বেশি হত। আর তাতে দলের মধ্যভাগের যে খেলোয়াড়টি উপরে উঠে খেলতেন তাঁদের জার্সি নম্বর হতো দশ।
১৯৯৩ সালের পর থেকে জার্সি নম্বর নির্ধারণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়। পূর্বে মাঠে খেলোয়াড়দের পজিশনের ওপর ভিত্তি করে নম্বর নির্ধারণের যে ধারণা প্রচলিত ছিল, তা থেকে সরে এসে খেলোয়াড়দের বিশেষত্বের বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়। আর তাই ’৯৩ এর পর থেকে দলের আক্রমণভাগের সবচেয়ে সৃজনশীল, কৌশলগত দিক দিয়ে অনন্য ও বল নিয়ন্ত্রণের দক্ষতাসমৃদ্ধ খেলোয়াড়দের জন্য ১০ নম্বর জার্সিটি বরাদ্দ রাখার প্রথা শুরু হয়।
তবে এক্ষেত্রে আগের সময়কার ফুটবল তারকাদের যে পরোক্ষ ভুমিকা ছিল, তা বলাই বাহুল্য। ’৫৭ থেকে ’৭৭- এ সময়ে চলেছিল পেলে-রাজত্ব। পেলের ক্যারিয়ারের শেষ দিকে আসা মিশেল প্লাতিনিও পরে আলো ছড়িয়েছিলেন। আবার ডাচ কিংবদন্তিদের মধ্যে ডেনিস বার্গকেম্প, ডেনিস লরাও ফুটবল বিশ্বে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিয়েছিলেন।
তবে পেলের সমসাময়িকদের মধ্যে যদি উল্লেখযোগ্য কারও নাম বলতেই হয়, তবে ইয়োহান ক্রুইফের নাম আসবেই, যদিও নিজের লম্বা ক্যারিয়ারে দুটিমাত্র মৌসুমে দশ নম্বর জার্সি গায়ে চড়িয়েছিলেন তিনি। নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে যেমন সুনাম কুড়িয়েছিলেন, তেমনি কোচিং ক্যারিয়ারেও নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। মূলত তাঁর ফুটবল দর্শন ও অনবদ্য কোচিং দক্ষতাই তাঁকে নিয়ে গিয়েছে সেরাদের কাতারে।
পেলে-পরবর্তী যুগে ফুটবল বিশ্বে ছড়ি ঘোরান ম্যারাডোনা। এ দুজন ভিন্ন সময়ের তারকা হওয়া সত্ত্বেও “সর্বকালের সেরা কে? পেলে নাকি ম্যারাডোনা?” এ প্রশ্ন চর্চিত হচ্ছে বেশ অনেকদিন ধরে। পরবর্তীতে রোনালদিনহো, ফ্রান্সেসকো টট্টি, ডেভিড ব্যাকহাম, ওয়েন রুনির মতো তারকারা প্রমাণ করতে থাকেন দশ নম্বর জার্সির সার্থকতা। মূলত তাঁদের মতো কিংবদন্তিদের হাত ধরেই এই দশ নম্বর জার্সি হয়ে ওঠে ‘আইকনিক টেন’।
আধুনিক ফুটবলে দলের এটাকিং মিডে বা প্লেমেকার হিসেবে খেলা খেলোয়াড়েরাই দশ নম্বর জার্সি গায়ে চড়িয়ে যাচ্ছেন। প্লেমেকার কী? তাঁদের নির্ধারিত পজিশন কোনটি? – এসবের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দেওয়া জটিল ব্যাপার। সাধারণত দলের মধ্যভাগের খেলোয়াড় ও স্ট্রাইকারের মধ্যকার সংযোগ স্থাপনের কাজটি করে থাকেন প্লেমেকাররা। ৪-৩-১-২ কিংবা ৩-৪-১-২ এর মতো ফর্মেশনগুলোর দিকে তাকালে প্লেমেকারদের ভূমিকা স্পষ্ট হবে। তবে ৪-৪-২ বা ৩-৪-৩ এর মতো ফর্মেশনগুলোতে তাঁদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়।
তবে ফুটবল মাঠে দলের সবচেয়ে সৃজনশীল, দূরদর্শী, বল নিয়ন্ত্রণের দক্ষতাসমৃদ্ধ ও গোল স্কোরিংয়ে এসিস্ট করতে সামর্থ্য রাখেন – এমন খেলোয়াড়দেরই বেশিরভাগ সময় প্লেমেকারের ভূমিকা নিতে দেখা যায়। এ কারণে এটাকিং মিডের পাশাপাশি দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবেও কখনও কখনও খেলতে দেখা যায় তাঁদের। হালের মেসি-নেইমার-দিবালারা তাই প্রায়ই দ্বিতীয় স্ট্রাইকারের ভূমিকায় খেলে যাচ্ছেন, যা পূর্বে করে দেখিয়েছিলেন ক্রুইফ-বার্গকেম্পরাও।
সময়ের ব্যবধানে এই জার্সি এখন অনেক অর্থ বহন করে। সাম্প্রতিক সময়ে পিএসজিতে মেসির আগমনে তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে নিজের জার্সি হাত বদল করতে চেয়েছিলেন নেইমার। আবার বার্সায় সে মেসিরই রেখে যাওয়া দশ নম্বর জার্সি গায়ে খেলে যাচ্ছেন আনসু ফাতি, যা বার্সা ভক্তদের মনে নতুন কিছুর আশার যোগান দিচ্ছে।এদিকে আবার মার্কাস রাশফোর্ড কিংবা ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচের মতো উঠতি তারকারাও এই আইকনিক জার্সি গায়ে খেলে যাচ্ছেন। কে জানে, হয়তো তাঁদের মধ্য থেকেই দেখা মিলবে আগামীর ফুটবল কিংবদন্তিদের।