দ্য কিং ইজ ডেড, লঙ লিভ দ্য কিং!

গিনিপিগের আয়ু সাধারণত ৪ থেকে ৮ বছর। কিন্তু এটির বয়েস ৫০ পেরিয়ে গেছে। ওয়ানডে ক্রিকেটের কথা বলছিলাম আর কি। সেই ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে জন্ম। কিন্তু ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা এই জিনিসটিকে নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বন্ধ করছে না।

আজকে ওয়ানডে ক্রিকেটের দশা ওই স্ট্র্যান্ড রোডের বাড়িটার মতো। যেটার গায়ে ২০ বছর ধরে পৌরসভা লিখে রেখেছে, বিপজ্জনক বাড়ি-যেকোনো সময়ে ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু এখনও কিভাবে যেন অক্ষত রয়ে গেছে। কেন এরকম বলছি? কয়েকটা তথ্য নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলেই বোঝা যাবে। তবে তার আগে ওয়ানডে ক্রিকেটের জীবন যুদ্ধের পানি কোন খাতে বয়েছে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে সেটার ওপর একটু আলোকপাত করা দরকার।

সেই ১৯৭১ সালে যখন ওয়ানডে ক্রিকেট (আন্তর্জাতিক। ইংল্যান্ডে তার অনেক আগে থেকেই লিমিটেড ওভারের ক্রিকেট খেলার চল ছিল) শুরু হয়, তখন ম্যাচটির দৈর্ঘ্য ছিল ৪০ ওভারের। অবশ্য সেই ম্যাচে ওভার প্রতি ৬ বলের জায়গায় ৮ বল করে খেলা হয়। সেবারের অ্যাশেজ সিরিজের তৃতীয় টেস্ট বৃষ্টিতে ভেস্তে যাওয়ায়, তড়িঘড়ি এই একজিবিশন ম্যাচের আয়োজন করা হয়।

উইজডেন তাদের ১৯৭২ সালের অলম্যানাকে এই ম্যাচের রিপোর্টই প্রকাশ করেনি। তাদের মনে হয়েছিল ওটা সাময়িক একটি একজিবিশন ম্যাচ। তার চার বছর পর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ছেলেদের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর। এই চার বছরে সাকুল্যে মাত্র ১৮টি ওয়ানডে খেলা হয়। সেবার বিশ্বকাপ ছিল ৬০ ওভারের এবং ৩০ গজের বৃত্তের নিয়মের বালাই ছিল না। এর বছর দুয়েক পর এমন এক ভদ্রলোকের ক্রিকেট ধরাধামে আবির্ভাব ঘটবে, যিনি ক্রিকেটকেই বদলে দেবেন। এবং এই বদলের সবচেয়ে বড় ঝটকা খাবে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।

ভদ্রলোকের নাম কেরি প্যাকার। এছাড়াও ১৯৮৩ সালে ভারত বিশ্বকাপ জিতে ওয়ানডে ক্রিকেটের আরেকটা বিপ্লব ঘটাবে। সে বিপ্লবের ধাক্কা এমনই, যে ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের আসর ইংল্যান্ড থেকে ভারতে স্থানান্তরিত হবে। এছাড়া ১৯৮৪ সালে শারজার অভিষেকের সাথে সাথে একদিনের ক্রিকেটের একটা বিরাট বড়ো দরজা খুলে যাবে। স্পনসরের দাবি মেনে এরপর ‘শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ওয়ানডে ক্রিকেটই ভরসা’ জাতীয় কলরবে মুখরিত হবে সমগ্র ক্রিকেট বিশ্ব।

উপরিউক্ত সব কটি ফ্যাক্টর ওয়ানডে ক্রিকেটকে মানুষের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। এবং ফল স্বরূপ ওয়ানডে ক্রিকেটের নিয়মও বদলে যায়। সাদা বল, রংচঙে জার্সি, ৩০ গজের বৃত্ত, প্রথম পনেরো ওভারের নিয়ম কানুন-এসবই দর্শকের কাছে ওয়ানডে ক্রিকেটের আবেদন বাড়িয়ে দেয়।

যদিও এই আবেদনময়তাও একদিন দর্শকের কাছে ফিকে হয়ে এসেছে। এবং সেই কারণেই নিয়মের আরো নানা রকম বদল ঘটিয়েছে ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা। তবে সে সব লিখতে গেলে ওয়ানডে ক্রিকেটের মহাভারত লেখা হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং কয়েকটা তথ্য আলোচনা করা জরুরি।

যদি বিশ্বকাপ থেকে বিশ্বকাপের সময়সীমা নির্ধারণ করে নি, তবে বেশ কয়েকটা জিনিস দেখতে পাবো। প্রথম, ১৯৭৫ এর বিশ্বকাপের আগে ওয়ানডে ক্রিকেটকে একরকম দুয়োরানি হিসাবে দেখা হতো। চার বছরে মাত্র ১৮টি ম্যাচ খেলা হয়েছিল। দ্বিতীয়, ভারতের বিশ্বজয় একদিনের ক্রিকেটের জন্যে যে বিশাল টনিক হিসাবে কাজ করেছিল তা স্পষ্ট। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ বিশ্বকাপ অবধি ১৩৬ ওয়ানডে খেলা হয়েছিল। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৭ সেই সংখ্যাটা ২৫৪। অর্থাৎ ৮৬.৭৬% বৃদ্ধি।

তৃতীয়, টি-টোয়েন্টির আবির্ভাবের ফলে ওয়ানডে ক্রিকেটের জৌলুস অনেকটাই কমেছে। ২০০৭ অব্দি প্রতি চার বছরের সময়সীমায়, বছরে গড় একদিনের আন্তর্জাতিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ২০০৭ থেকে ২০১১, এই সময়ে প্রথমবার বছরে গড় একদিনের আন্তর্জাতিকের সংখ্যা আগের ৪ বছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে।

টেস্ট ক্রিকেট কিন্তু এর মধ্যেও স্বমহিমায় বিরাজ করেছে। দুটি বাদে প্রতিটি চার বছরের ব্লকেই বছরে গড় টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং হ্রাস টাও সামান্যই। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়ে চিন্তার বিষয় এটাই যে, ২০১৯ বিশ্বকাপ পরবর্তী এই আড়াই বছরে বছরে গড় ওয়ানডের সংখ্যা মারাত্মক ভাবে হ্রাস পেয়েছে।

যদি ধরেও নি যে ২০% ছাড় দেওয়াই যায় করোনার জন্যে, তবুও সংখ্যা এটাই বলছে যে ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। ২০১৫ থেকে ২০১৯-এই চার বছরে গড়ে ১৩৬ টি করে ওয়ানডে খেলা হয়েছে। কিন্তু এই আড়াই বছরে গড়ে মাত্র ৭৮টি ওয়ানডে খেলা হয়েছে।

অর্থাৎ ৪২.৬৫% হ্রাস। জিডিপির থেকেও ভয়ানক হ্রাস! টেস্ট ক্রিকেট সেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। ২০১৫ থেকে ২০১৯, গড়ে ৪৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়েছে। সেখানে এই আড়াই বছরে ৩৪। অর্থাৎ ৩০.৬১% ।এভাবে দেখলে সংখ্যাটা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, কিন্তু কোরোনার জন্যে যতগুলো টেস্ট ম্যাচ একেবারে খেলাই হয়নি, সেটা ধরলে বাৎসরিক টেস্ট ম্যাচের গড় কিন্তু ৫০ ছাড়িয়ে যায় এই আড়াই বছরেও।

ক্রিকেটের বিশ্বায়ন করতে গিয়ে একদিনের ক্রিকেট চরম অবহেলিত হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ওয়ানডে ক্রিকেট দীর্ঘ দিন ধরে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছে। আজ তার এপিটাফ লেখার তোড়জোড় একপ্রকার শুরু হয়ে গেছে দেখলে একটু কষ্ট হয় বৈকি। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মাঝের ওভার গুলোয় একদিনের ম্যাচে খেলা ঘুমিয়ে যায়। তাছাড়া সারাদিন ধরে একদিনের ম্যাচ দেখার স্পৃহাও এই ব্যস্ত জীবনে অনেকটাই কম।

মাঝের ওভারের সমস্যা কাটানোর জন্যে, ৩০ গজ বৃত্ত, পাওয়ার-প্লে ইত্যাদি নানান নিয়ম নিয়ে এসেছে আইসিসি। কিন্তু একদিনের ক্রিকেটের স্বাস্থ্য ফেরেনি। যদিও ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সময় প্রতিবার শোনা যায়, ‘একদিনের ক্রিকেট মরে নাই।’ কিন্তু মাঝের সময়টুকুতে একদিনের ক্রিকেটে দর্শকের আগ্রহই নেই। ট্রাই সিরিজ কবেই উঠে গেছে। শেষ বোধহয় ২০১৪-১৫ তে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ভারতের একটি সিরিজ দেখেছিলাম।

আজকাল প্রতিটি সফরে টেস্ট ম্যাচের পিছনে আর ওয়ানডে গুঁজে দেওয়া হয় না। তার জায়গা নিয়েছে টি-টোয়েন্টি। পাঁচ বা সাত ম্যাচের সিরিজও হয় না। সবই তিন ম্যাচের। এতকিছুর পরেও আইসিসি. ইভেন্টের সম্রাট কিন্তু ওই ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ। হলফ করে বলতে পারি, ২০১১ সালে ওয়ানখেড়ের ফাইনালে ভারত হারলে, রাঁচির ভদ্রলোক তাঁর মুকুটের বাকি সব কটি পালক অক্ষত রেখেও এতটা সমাদৃত হতেন না। রাহুল দ্রাবিড় অধিনায়ক হিসবে কলকে পান না, শুধু মাত্র ২০০৭ এর ক্যারিবিয়ান বিপর্যয়ের কারণে।

বেহালার ভদ্রলোকের মতো ওপিনিয়ন ডিভাইড করতে আমি আর বেশি ক্রিকেটারকে দেখিনি। হলফ করে এও বলতে পারি, ২৩ মার্চের জোহানেসবার্গে ফলাফলটা অন্যরকম হলে, তিনিও মহেন্দ্র সিং ধোনি বা কপিল দেবের মতোই সমাদৃত হতেন ভক্তকুলের মাঝে। তবুও আজ টেস্ট ক্রিকেটের হ্যালোজেন ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফ্লাডলাইটের মাঝে ওয়ানডে ক্রিকেট গেরস্থ বাড়ির কুলুঙ্গির প্রদীপ। এবং সেই প্রদীপ আর কদ্দিন জ্বলবে, বোঝা যাচ্ছে না । ঘুরেফিরে সেই কথাটা মনে হচ্ছে -‘দ্য কিং ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিং।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link