দ্য ম্যান উইদ গোল্ডের আর্ম

ছোট্ট স্পেলে কখন এসে যে ব্রেক থ্রু দিয়ে দিত, অবিশ্বাস্য উইকেট তুলে দিত তা বোলার শচীনকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। বোলিংয়ে এত অস্ত্র ও সাহস বোধহয় অনেক নিয়মিত বোলারের ছিলনা। টেনিস এলবো বোলার শচীনের অনেক ক্ষতি করেছে ঠিকই কিন্তু ব্যাটে ব্যর্থ হয়েও অনেক ম্যাচ বোলিংয়েই জিতিয়ে দিয়েছে শচীন। শচীনের বোলিং দক্ষতা পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করা যাবেনা, আসলে শচীন হল সত্যিকারের ‘দ্য ম্যান উইদ গোল্ডেন আর্ম’।

১৯৮৭ সালে ১৪ বছরের কোঁকড়ানো চুলে বেঁটে ছেলেটা চেন্নাইয়ের এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে ফাস্টবোলিংয়ের ট্রেনিং নিতে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ফাস্টবোলার ডেনিস লিলি সব দেখেশুনে তাঁকে ব্যাটিংয়েই জোর দিতে বলেছিল। তারপরেরটা টা তো ক্রিকেট ও শচীনের সমার্থক হওয়ার সহবাস!

ওই উচ্চতায় ফাস্টবোলার হওয়া যায়না কিন্তু কব্জি ঘুরিয়ে বলটাতো ঘোরানো যায়। শচীনের বোলিংয়ের হাতটাও বেশ। আসলে শুধু ২-৪ ওভার কাটিয়ে দেওয়ার জন্য যাইহোকক বল করতোনা বলের বৈচিত্র ছিল দেখার মতো। ফ্লাইট, গুগলি, লেগস্পিন, অফস্পিন, লেগ কাটার সবধরণের বলই করতে পারতো। ওভারে ৬টা বল ৬ রকম করতে পারতো। ফ্লাইট দিত, ভালোবাসতো ব্যাটসম্যানকে অ্যাটাক করতে।

টেস্টে ৪২৪০ আর ওয়ানডেতে ৮০৫৪ টি বল করেছে শচীন। টেস্টে উইকেট সংখ্যা ৪৬ আর ওয়ানডেতে ১৫৪। একমাত্র টি-টোয়েন্টি খেলেও একটি উইকেট, জাস্টিন কেম্পের!

১. শারজায় উইলস ট্রফির পঞ্চম ম্যাচে (২২শে অক্টোবর ১৯৯১) ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪৬.২ ওভারে ১৪৫ রানে অল আউট হয়ে যায়। শচীন ১ মেডেন সহ ১০ ওভারে ৩৪ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হন। বোলিং পারফরমেন্সে এটি শচীনের প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ!

২. পার্থে বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপের প্রথম ম্যাচ (ডিসেম্বর ৬,১৯৯১)

অ্যামব্রোস (২/৯, ৮.৪ ওভারে), মার্শাল(২/২৩), কামিন্সদের (২/২১) দাপটে ভারত ৪৭.৪ ওভারে ১২৬ রানে অল আউট হয়ে যায়। জবাবে ব্যাট করতে নেমে কপিল দেব(২/৩০), শ্রীনাথ (২/২৭), সুব্রত ব্যানার্জীর(৩/৩০) দাপটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ১২১ রানে যখন হার-জিতের দোলাচলে তখন ৪১ তম ওভারে বল করতে আসেব শচীন। প্রথম ৫ বলে ৫ রান নিলেও শেষ বলে স্লিপে আজহারউদ্দীন কামিন্সের দুর্দান্ত ক্যাচ নিলে ম্যাচ ড্র হয়ে যায়!

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এটাই ছিল সুব্রত ব্যানার্জীর অভিষেক ম্যাচ!

৩. অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিডনির তৃতীয় টেস্ট(১৯৯২) ইনিংস হার থেকে ১৭০ রান দূরে অস্ট্রেলিয়া ১১৪ রানে ৬ উইকেট হারিয়েও যখন বর্ডার ও হিউজ খেলে ধরে নিয়েছে আর ৭৬ মিনিটে জুটিতে ৫০ রান যোগ করে জাঁকিয়ে বসেছে তখন ক্যাপ্টেন আজহার শচীনের হাতে বল তুলে দেয়! এসেই প্রভাকরের দুরন্ত ক্যাচে হিউজকে আউট করে। ওই ১ ওভারই দেয় কিন্তু তারপর আর বল দেয়নি শচীনকে। আর অস্ট্রেলিয়া দিনের শেষে ১৭৩/৮ এ থামে! হয়তো আরও বল দিলে! এটাই শচীনের প্রথম টেস্ট উইকেট!

৪. কলকাতায় হিরো কাপের (সিএবি জুবিলি টুর্নামেন্ট) প্রথম সেমিফাইনালে (২৪শে নভেম্বর, ১৯৯৩) ভারত নির্ধারিত ৫০ ওভারে ১০ উইকেটে তোলে ১৯৩ রান।জবাবে ৪৯ ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার রান ৮ উইকেটে ১৯০। শেষ ওভারে জেতার জন্য দরকার ৬ রান। স্ট্রাইকে তখন ৪৮ রানে অপরাজিত ব্রায়ান ম্যাকমিলান। প্রথম বলে ২ রান নিতে গিয়ে রান আউট হ। ফ্যানি ডিভিলিয়ার্স। ডোনাল্ড স্ট্রাইকে এসে পরপর ৩ বল ডট খায় আর পঞ্চম বলের মাথায় সিঙ্গল নিয়ে ম্যাকমিলানকে স্ট্রাইক দিলেও শেষ বলে মাত্র ১ রান নিতে পারে। ফলে ভারত ২ রানে ম্যাচ জিতে যায়!

৫. রাজকোটের প্রথম ওয়ানডেতে(১৫ ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪) ভারতের ২৪৬ রানের জবাবে শ্রীলঙ্কা হারে মাত্র ৮ রানে। পরপর দুই ওপেনারকে (দিলীপ সামারাবীরা ও রোশন মহানামা) আউট করে জয়ের রাস্তা দেখায় শচীন। রনতুঙ্গাকেও আউট করে। ৮ ওভারে ৪৩ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেয় শচীন।

৬. মোহালিতে টাইটান কাপের নবম ম্যাচ (তিন নভেম্বর ১৯৯৬)। ভারতের ২৮৯ এর জবাবে ৪৯ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার রান ৯ উইকেটে ২৮৪। শেষ ওভারে জেতার জন্য দরকার ছিল ৬ রান। ক্রিজে তখন ব্র‍্যাড হগ ও গ্ল্যান ম্যাকগ্রা। ২ উইকেট নেওয়া রবিন সিংয়ের ৩ ওভার তখনও বাকী ছিল। ক্যাপ্টেন শচীন নিজে বল করতে যায় ও প্রথম বলে ব্র‍্যাড হগ রান আউট হয়। ফলে ভারত ৫ রানে ম্যাচ জিতে যায়!

ওয়ানডে ক্রিকেটে শেষ ওভারে ২ বার ৬ রান ডিফেন্ড করার নজির একমাত্র শচীনেরই আছে।

৭. কোচিতে পেপসি ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচে(১ এপ্রিল,১৯৯৮) ব্যাটিং সহায়ক পিচে ভারত নির্ধারিত ৪৯ ওভারে ৫ উইকেটে করে ৩০৯ রান। জবাবে অস্ট্রেলিয়া দুর্ধর্ষ শুরু করে ১১ ওভারে ১০০, ২০ ওভারে ১৪০ আর ৩১ ওভারে ৩ উইকেটে ২০০ রান পের করে দেয়! শচীন পরপর উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার হেসেখেলে জেতা ম্যাচকে তাদের হারিয়ে দেয় ৪১ রানে। শচীন ১০ ওভারে ১ মেডেন সহ ৩২ রানে নেয় ৫ উইকেট!

৮. ঢাকায় উইলস আন্তর্জাতিক কাপের তৃতীয় কোয়াটার ফাইনালে(২৮ অক্টোবর ১৯৯৮) শচীনের ১২৮ বলে ১৪১রানে ভর করে ভারত নির্ধারিত ৫০ ওভারে তোলে ৮ উইকেটে ৩০৭। জবাবে অস্ট্রেলিয়া ৪৮.১ ওভারে ২৬৩ রানে অল আউট হয়ে যায়! স্টিভ ওয়াহ, মাইকেল বেভান,মার্টিনের উইকেট সহ শচীন ৯.১ ওভারে ৩৮ রানে নেয় ৪ উইকেট।

৯. অধিনায়ক শচীনের শেষ সিরিজের,মুম্বইতে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্টে(ফেব্রুয়ারি ২০০০) প্রথম ইনিংসে দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৯৭ করলেও বাকীরা কেউই দাঁড়াতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ইনিংসে দলের বাকী বোলাররা যখন কিছু করতে পারেনি তখন নিজে বল করতে আসে আর বামহাতি ব্যাটসম্যানকে অফস্পিন এবং ডানহাতিকে লেগ স্পিন করা শুরু করে। ৯০ রানের মাথায় তাদের প্রথম উইকেট পড়ে। শচীনে ১ মেডেন সহ ৫ ওভারে ১০ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেয় দুই ওপেনার গ্যারি কার্স্টেন ও হার্শেল গিবস-সহ শন পোলককে আউট করে!শেষ পর্যন্ত ভারত ম্যাচটি হেরে যায়!

১০. ২০০১ এর ঐতিহাসিক ইডেন টেস্টে হরভজনের কেরামতি সত্ত্বেও পরপর তিন ওভারে গিলক্রিস্ট, জাঁকিয়ে বসা হেডেন সহ ওয়ার্নকে শচীন না ফেরালে জেতা কিন্তু চাপের হয়ে যেত! শচীনকে জাস্ট প্রান্ত বদলের জন্য এক ওভার দিতে চেয়েছিল সৌরভ কিন্তু!

১১. ২০০২ সালে সেন্ট জোন্সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেই বিখ্যাত চতুর্থ টেস্ট, যেখানে কুম্বলে চোয়ালে চোট পেয়েছিল।এই টেস্টে কুম্বলে মাত্র ১৪ ওভার বল করেছিল আর শচীন টেস্টে এত ওভার বল করে কুম্বলে মাঠা না থাকার জন্য একমাত্র স্পিনার হিসেবে! ৩৪-৪-১০৭-২ ফিগারে ৬৫ করা ওয়েবেল হাইন্স আর ১৩৬ করা কার্ল হুপারের উইকেট তুলে নেয়!

এই টেস্টে উল্লেখযোগ্য বিষয় যে বিপক্ষের ২ উইকেটকিপারই (রাতরা-১১৫*, জেকবস-১১৮) টেস্টে প্রথমবারের জন্য টেস্টে সেঞ্চুরি করে আর ভারতের ১১ জনই বল করে!

১৩. ২০০৩ এ অ্যাডিলেড টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে সবচেয়ে সেট দুই ব্যাটসম্যান স্টিভ ওয়া এবং ড্যামিয়েন মার্টিনকে ফিরিয়ে ব্রেক থ্রু দেয় শচীন।

১৪. কোচির প্রথম ওয়ানডেতে (দুই এপ্রিল,২০০৫) ভারত নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে করে ২৮১। ওই ম্যাচে শচীন ১ মেডেন সহ ১০ ওভারের ৫০ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট নেয়। ভারত জেতে ৮৭ রানে! ওয়ানডেতে এটি শচীনের দ্বিতীয় ৫ উইকেট হল যেখানে ওয়ার্নের মাত্র একটি।

মুলতান টেস্টে (২০০৪) মইন খানকে বোল্ড করা সেই ম্যাজিক বলকে ভুলি কী করে? মজার ব্যাপার হল শচীনের বলে ইনজামাম সাতবার, ব্রায়ান লারা ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার চার বার করে আউট হয়েছে!

কিছু তথ্য এখানে না দিলেই নয়।

১. শচীনের প্রথম ওয়ানডে উইকেট রোশন মহানামা(মোরে ক্যাচ) (দ্বিতীয় ওয়ানডে, পুনে,৫ ডিসেম্বর,১৯৯০), দামিকা রনতুঙ্গাকে আউট করে ওই ম্যাচে।(২ জনই ওপেনার)

২. শচীনের প্রথম টেস্ট উইকেট মার্ক হিউজ(প্রভাকর ক্যাচ,১৯৯২,সিডনি টেস্ট)।

৩. শচীনের প্রথম ও একমাত্র আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি (এক ডিসেম্বর, ২০০৬,জোহানসবার্গ) উইকেট, জাস্টিন কেম্প (লেগ বিফোর)।

৪. শচীন একমাত্র কেনিংস্টন ওভালে(২০০২) কোন টেস্ট ইনিংসে বোলিং ওপেন করে।

৫. ইডেন টেস্টে (২০১৩) শেন শিলিংফোর্ডের উইকেটটি শচীনের ২০০ তম আন্তর্জাতিক উইকেট, যা ছিল শচীনের ১৯৯ তম টেস্ট।

৬. বিশ্বে ১১ জনের মধ্যে শচীন ১ জন যারা একই ওয়ানডে ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ৪ উইকেট নিয়েছে(২৮ অক্টোবর,১৯৯৮, ঢাকায়, উইলস কাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে একদিনের আন্তর্জাতিকে মাত্র ৩ জন একই ম্যাচে ১০০ রান ও ৫ উইকেট নিয়েছে। তার হল ভিভ রিচার্ডস (১১৯, ৫ উইকেট; ১৮ মার্চ ১৯৮৭, দুনেদিন, নিউজিল্যান্ড) ,পল কলিংউড (১১২*,৬ উইকেট; জুন ২১, ২০০৫, নটিংহ্যাম, বাংলাদেশ)। এছাড়াও সহযোগী দেশের (সংযুক্ত আরব আমিরাত) রোহান মুস্তাফাও(১০৯, ৫ উইকেট; ৪ এপ্রিল, ২০১৭, আবুধাবি,পাপুয়া নিউগিনি) এই রেকর্ড গড়েছেন!

ছোট্ট স্পেলে কখন এসে যে ব্রেক থ্রু দিয়ে দিত, অবিশ্বাস্য উইকেট তুলে দিত তা বোলার শচীনকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। বোলিংয়ে এত অস্ত্র ও সাহস বোধহয় অনেক নিয়মিত বোলারের ছিলনা। টেনিস এলবো বোলার শচীনের অনেক ক্ষতি করেছে ঠিকই কিন্তু ব্যাটে ব্যর্থ হয়েও অনেক ম্যাচ বোলিংয়েই জিতিয়ে দিয়েছে শচীন। শচীনের বোলিং দক্ষতা পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করা যাবেনা, আসলে শচীন হল সত্যিকারের ‘দ্য ম্যান উইদ গোল্ডেন আর্ম’।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...