আগ্রাসন, দ্য আদার আর্ট অব ফাস্ট বোলিং

আর্ট অব ফাস্ট বোলিং’ - ডেনিস লিলির এই বইটি সম্ভবত সম্পূর্ণ ক্রিকেটেরই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত বই। আমাদের দেশে ক্রিকেট নিয়ে পড়াশোনা হয় খুব কম, এমনকি যারা পেশা হিসেবে ক্রিকেটকে বেছে নিতে চায়, তাত্ত্বিক এই জায়গাগুলোতে তাদেরও খুব একটা আগ্রহ নাই।

আর্ট অব ফাস্ট বোলিং’ – ডেনিস লিলির এই বইটি সম্ভবত সম্পূর্ণ ক্রিকেটেরই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত বই। আমাদের দেশে ক্রিকেট নিয়ে পড়াশোনা হয় খুব কম, এমনকি যারা পেশা হিসেবে ক্রিকেটকে বেছে নিতে চায়, তাত্ত্বিক এই জায়গাগুলোতে তাদেরও খুব একটা আগ্রহ নাই।

তারপরেও যারা পড়েছেন, তারা জানেন বইটিতে একজন ফাস্ট বোলার হয়ে ওঠার জন্য একজনের প্রস্তুতি, টেকনিকের ঝালাই, ডায়েট কিংবা ম্যাচ প্রস্তুতির যেই ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তার সাথে খুব বেশি দ্বিমত করার উপায় নেই। লেখক যখন সর্বকালের অন্যতম সেরা একজন ফাস্ট বোলার, আপনি এর থেকে কমও কিছু আশা করতে পারেন না। কিন্তু আমি যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই, তা সম্পূর্ণই আলাদা কিছু। খুব একটা টেকনিক্যাল বিষয় নয়, বরং অনেকাংশেই মনস্তাত্ত্বিক, নামকরণ করলাম ‘দ্য আদার আর্ট অব ফাস্ট বোলিং’।

বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য একটু ভিন্নভাবে শুরু করা দরকার। চলুন, ছেলেবেলায় ফেরা যাক। ক্রিকেটপাগল কিশোর হিসেবে সারাদিন টেলিভিশনে ওয়াসিম, ম্যাকগ্রা থেকে শুরু করে শোয়েব, ব্রেট লি, শেন বন্ড হয়ে আমাদের নিজেদের মাশরাফির খেলা দেখে, ইচ্ছাকৃতভাবে বা মনের অজান্তেই একটা লাফ দিয়ে উঠে কাল্পনিকভাবে বল ছুড়ে মারতেন কাল্পনিক ব্যাটসম্যান শচীন, লারা কিংবা এলাকার কোন সেরা ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে।

ফলাফল? আপনি, আমি সবাই জানি। কল্পনায় ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প নেই, বাস্তবে হঠাৎ সামনে পড়ে যাওয়া মুরব্বীকে দেখে লজ্জা পাওয়া। এবারে, আরেক লাফে বিকালের খেলার মাঠে যাওয়া যাক। কোন প্রশিক্ষণ ছাড়া খেলার মাঠে, যেখানে খেলার আনন্দেই আপনি ক্রিকেট খেলতেন। আপনি একজন ফাস্ট বোলার। কোন একজন সেরা বোলারের বোলিংয়ের ধরন হুবহু অনুকরন করে কিংবা সম্পূর্ণই আপনার নিজস্ব ভঙ্গিতে বোলিং করেন। এতটুকু তো নিশ্চিত, গায়ে যতটুকু শক্তি ছিলো, সবটুকু দিয়েই বলটা ছুড়ে দিতেন?

বোলিংয়ের টেকনিক জানা নেই, অনেক বলেরই লাইন-লেন্থ ঠিক থাকতো না। টিমমেটরা বলে উঠতেন, বলের জোর কমিয়ে লাইনটা আগে ঠিক করো। সত্য বলুন তো, কতবার এই উপদেশ মেনে নিয়েছেন? বরং পরের বলটা আরো কতটা জোরে ছোড়া যায় সেই চেষ্টাই করেছেন।

কিংবা, আপনার ফাস্ট বোলার সুলভ ইগোকে তোয়াক্কা না করে ব্যাটসম্যান বন্ধু বলটিকে তুলে মেরেছেন লং অন কিংবা মিড উইকেটের উপর দিয়ে। পরের বলটিতে? নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সেই বলটিতে যতটুকু জোর ছিলো, এর থেকে জোরে আপনি বল ছুড়তে পারেন না। এর নাম আগ্রাসন, অ্যাগ্রেসিভনেস, দ্য আদার আর্ট অব ফাস্ট বোলিং।

শন টেইটের অভিষেকের কথা মনে আছে? তিনি গণ্ডায় গণ্ডায় উইকেট নিবেন বলে দলে নেয়া হয়েছিল? অস্ট্রেলিয়া দলে ফাস্ট বোলারের ঘাটতি ছিলো বলে আনকোরা টেইটকে দরকার ছিলো? স্টিভ হার্মিসনের বাউন্সারে রিকি পন্টিংয়ের গাল কেটে গিয়েছিলো, পন্টিংয়ের অহমিকায় আঘাত হেনেছিলেন স্টিভ হার্মিসন, এর জবাব দেয়া প্রয়োজন ছিলো। পন্টিং ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভয় দেখতে চেয়েছিলেন, একারনেই টেইটের অভিষেক হয়। ফলাফল ভিন্ন আলোচনা কিন্তু যুগে যুগে ফাস্ট বোলাররা ভয় তৈরি করতে পারেন বলেই তারা ফাস্ট বোলার।

শোয়েব আখতার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কতগুলো উইকেট নিয়েছেন? শেন বন্ড? কার্টলি এমব্রোস? তাদের থেকে অনেক বেশি উইকেট নেয়া ফাস্ট বোলাররা আছেন। যথাযথ সম্মান জানিয়েই জানাতে চাই, অজিত আগারকার কিংবা আব্দুল রাজ্জাকের ওয়ানডে উইকেট সংখ্যাও তাদের থেকে বেশি। কিন্তু তারপরেও তারা একটা যুগকে নির্ধারণ করে গিয়েছেন।

আপনি তাদের আক্রমণ করতে পারেন কিন্তু ভাঙতে পারবেন না। পরের বলেই তারা দ্বিগুন বিক্রমে আপনার দিকে ছুটে আসবে। তারা যে আপনাকে পছন্দ করছেন না, তাদের শরীরী ভাষাতেই প্রকাশ পাবে। ব্যাটের কানা ছুইছুই একটা বল বেড়িয়ে গিয়ে কিপারের গ্লাভসে পৌছানোর আগেই দেখবেন তারা আপনার সামনে দাঁড়িয়ে, জবাব চাচ্ছেন।

ঠিকভাবে একটা বল খেলা গেলো না, বোলার আপনার চেহারার সামনে, জবাব চাইছেন। একটা বলকে সজোরে ব্যাট চালিয়ে বাউন্ডারি ছাড়া করা গেলো, পরের বলের নিশানা নিশ্চিতভাবেই ব্যাটসম্যানের মাথা অথবা পায়ের আংগুল। তারা কেবল বল করেন না, ব্যাটসম্যানের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করেন। আহ, আগ্রাসন! কি মধুর সঙ্গীত!

কথাগুলো বলার কারন, আমাদের একজন আগ্রাসী ফাস্ট বোলার প্রয়োজন, আমাদের একজন বোলার তামিম ইকবাল প্রয়োজন, একজন ফাস্ট বোলার সাকিব আল হাসান প্রয়োজন। স্লেজিং এর জবাব হিসেবে পোর্ট অব স্পেনে জাহির খানকে তামিম যেভাবে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেন কিংবা সিরিজের শুরুতে নিজেদের ফেবারিট দাবি করে সাকিব যেমন মিরপুরে নিউজিল্যান্ডকে ছিড়ে ফেলেন, ঠিক তেমনই একজন ফাস্ট বোলার প্রয়োজন।

প্রতিটা বাউন্ডারির বিপরীতে ব্যাটসম্যানকে আছড়ে ফেলতে চাওয়া ফাস্ট বোলার, প্রতিটা ওভার বাউন্ডারির সাথে ব্যাটসম্যানকে ছিড়ে ফেলতে চাওয়া ফাস্ট বোলার প্রয়োজন। RAW, বুনো, ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলার।

তাসকিন যেবার প্রথম জাতীয় দলে আসেন, আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। তার মধ্যে আগ্রাসন দেখেছিলাম। ভারতের বিপক্ষে অভিষিক্ত সিরিজে তিনি ভয় ধরিয়েছিলেন, সেবারের বিপিএলে দিলশান তাকে ভয় পেয়েছিলেন। মনে থাকলে দেখবেন, দিলশান বলের লাইনে শরীর নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন, একটা ইনসুইঙ্গারে বোল্ড হওয়া ছিলো সময়ের ব্যাপার মাত্র।

বোলিং অ্যাকশন পরিবর্তন, এতগুলো ইনজুরির পরেও ফিরে আসা, গতি ধরে রাখার ইচ্ছে দেখে তার প্রতি সম্মান বাড়ে। কিন্তু সেই আগ্রাসনটা কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছেন, শরীরী ভাষাটা নেই আর। তার গতি ব্যাটসম্যানের মধ্যে ভয় তৈরি করে না কিন্তু প্রায় একই গতির শাহীন শাহ কিংবা বুমরারা ভয় তৈরি করেন।

তাসকিনের ১৫০ কিমি গতি অর্জনের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই, সাথে দেখতে চাই প্রত্যেকটা বলের জন্য তিনি ব্যাটসম্যানের কাছে জবাব চাইবেন। উইকেট লাভের পরে তাসকিনের যে বুনো হুঙ্কার দেখা যায়, ঠিক ততটুকুই বুনো আক্রোশ প্রতিটা বাউন্ডারির পরে দেখতে চাই। ব্যাটসম্যানরা তাসকিনের আগ্রাসন দেখে ভয় পাবেন দেখতে চাই।

প্রসঙ্গক্রমে, সর্বশেষে জানিয়ে রাখি, শরিফুলের ইজি বোলিং অ্যাকশন আমার ভালো লাগে, আগ্রাসন আরো বেশি ভালো লাগে। তার রানআপ পরিশীলিত নয়, লোড আপ নিয়ে আরো কাজ করতে হবে, এর ফলাফল তার বোলিং স্পিডে দেখা যায়। ফাস্ট বোলিংয়ের টেকনিক্যাল অংশ নিয়ে পরবর্তী লেখায় জানানো যাবে। আমি কেবল দেখতে চাই, টেকনিক্যাল পরিশীলনের সাথে সাথে শরিফুল আগ্রাসনটুকুও ধরে রাখবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link