অভিজ্ঞতার ঝুলন্ত মূলা

গেল বিশ্বকাপের মতো এবারও বিশ্বকাপের প্রাক্কালে অভিজ্ঞতার মূলা ঝুলানো শুরু হয়ে গেছে। যথারীতি এ মুলা ঝুলানোর কাজটা করছে একাধিক গণমাধ্যম এবং কিছু সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমান ক্রিকেট-বিশ্লেষক। তাঁদের মতে, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর তুলনায় বেশি অভিজ্ঞ একটা দল৷ তাই তাঁদের বিশ্বকাপ জেতার সম্ভবনাও না-কি বেশ।

এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্বকাপের মতো আসরে শিরোপা জেতার পেছনে ‘অভিজ্ঞতা’ একটা নিয়ামক হলেও এটাই কি একমাত্র কিংবা চূড়ান্ত নিয়ামক? উত্তর হলো, না। একটা বিশ্বকাপ জিততে আরও অনেক প্রভাবক কাজ করে। বিশ্বকাপ কোনো ঠুনকো কিছু নয় যে, শুধু অভিজ্ঞতা দিয়েই তা জয় করা যায়। বাংলাদেশ যদি এবার বিশ্বকাপ জিতেও যায়, তার পরেও এ কথাগুলো মিথ্যে হয়ে যাবে না এবং আমি এগুলোতেই স্থির থাকব।

শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে যে কাজ হয় না, সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণও কিন্তু আমরাই। গেল বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না! সে দলটা কিন্তু এবারের দলটার চেয়েও বেশি অভিজ্ঞ ছিল।

তখন বোর্ডের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সুর ধরে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেকেই বড়াই করে বলতেন, আমাদের সাজঘরে রয়েছে ৭০(আসলে ৬৯) বছরের অভিজ্ঞতা, যা অন্য কোনো দলের নেই। বলাই বাহুল্য, তখন পর্যন্ত পঞ্চপাণ্ডবের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কাটিয়ে দেওয়া বছরগুলোর সামষ্টিক হিসাব ছিল এটি।

যদিও এই তথাকথিত ৭০ বছরের অভিজ্ঞতার চূড়ান্ত ফলাফল ছিল দশ দলের মধ্যে অষ্টম হয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন শেষ করাটা।

চার বছর ঘুরে এবার আবারও সেই অভিজ্ঞতার রব ওঠতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। এবারের দলটা গেলবারের চেয়ে তুলনামূলক কম অভিজ্ঞ হলেও এবারের লক্ষ্যটা ছাপিয়ে গেছে সবশেষ বিশ্বকাপের লক্ষ্যকেও। ২০১৯ বিশ্বকাপে যেখানে দেশের অধিকাংশ ভক্ত-সমর্থকের লক্ষ্য ছিল সেমিফাইনালে খেলা, সেখানে এবার তাঁদের লক্ষ্য বিশ্বকাপ জেতা।

স্বপ্ন দেখা বা বড়ো লক্ষ্য থাকা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেখানে বাস্তবতাটাও মাথায় রাখতে হয়৷ নয়তো পরে রূঢ় বাস্তবতা মেনে নিতে খুব বেগ পেতে হয়, যেটা চার বছর আগে বাংলাদেশি সমর্থকদের হয়েছিল। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো উদ্‌বেগের জায়গাটা হলো, মানুষকে কিছু ভুজুংভাজুং দিয়ে কিংবা ওই অভিজ্ঞতার মুলা ঝুলিয়ে এ-রকম স্বপ্ন দেখতে প্রভাবিত করায়। আর এ কাজটাই করছে দেশের নির্দিষ্ট কিছু গণমাধ্যম, সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট-বিশ্লেষক।

এবার অবশ্য কাজটা আরও সহজ হচ্ছে ওয়ার্ল্ড কাপ সুপার লিগে বাংলাদেশের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের দরুন। অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্বকাপ জেতার যে রব ইতোমধ্যে ওঠতে শুরু করেছে, সেটাকে আরও মজবুতভাবে আগলানো হচ্ছে পয়েন্ট টেবিলের তিনে অবস্থান করে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ সুপার লিগ মিশন শেষ করার বিষয়টি।

নি:সন্দেহে গেল তিন বছর ধরে এই প্রতিযোগিতায় দারুণ একটা সময় কাটিয়েছে বাংলাদেশ৷ তবে এটাকে লক্ষ্য করে যদি বিশ্বকাপ জেতার যুক্তিকে ডিফেন্ড করা হয় বা বিশ্বকাপের সাথে এই প্রতিযোগিতাকে গুলিয়ে ফেলা হয়, সেটা শুভংকরের ফাঁকি বই কিছু নয়।

বিশ্বকাপ ও বিশ্বকাপ সুপার লিগ ভিন্ন দুটা আঙ্গিকের প্রতিযোগিতা। এ দুটার ইনটেনসিটিতে আকাশপাতাল ফারাক। যেখানে সুপার লিগে বাংলাদেশ একটা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলেছে তিনটি করে ম্যাচ, সেখানে বিশ্বকাপে খেলতে হবে একটি করে।

সুপার লিগে বাংলাদেশের সামনে ম্যাচ ছিল চব্বিশটি, কিন্তু বিশ্বকাপে থাকবে নয়টি। সুতরাং, এখানে ভুলভ্রান্তির সুযোগ খুবই কম। কারণ, এখানে কামব্যাক করার সুযোগও তুলনামূলকভাবে কম। ধরুন, কোনো কারণে বাংলাদেশ তুলনামূলক কম শক্তিধর একটা দলের বিপক্ষে পা হড়কালো বিশ্বকাপে।

তাতে কিন্তু এক নিমিষেই দলের ওপর পাহাড়সম চাপ এসে পড়বে, যে চাপটা ছিল না সুপার লিগের কোনো ম্যাচে। কারণ, সেখানে ম্যাচও ছিল অনেক। আর সুপার লিগের ফলাফলই যদি বিশ্বকাপ জেতার নিয়ামক হয়, তা হলেও তো আমরা চ্যাম্পিয়ন হব না। চ্যাম্পিয়ন হবে নিউজিল্যান্ড, যেহেতু তাঁরা সেখানে পয়েন্ট টেবিলে সবার উপরে ছিল।

দেখুন, আমি কিন্তু ওয়ার্ল্ড কাপ সুপার লিগে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সকে একটুও খাটো করে দেখছি না। এর সুযোগও নেই। তবে আমার আপত্তিটা হলো, ওই প্রতিযোগিতার উদাহরণ টেনে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্নকে জাস্টিফাই করার ব্যাপারটায়। কেননা, এসব মুলা ঝুলিয়ে ক্রিকেট অনুসারী জনতাকে প্রভাবিত করতে দেখাটা কিংবা বাস্তবতা থেকে দূরে ঠেলে দেওয়াটা তাঁদের প্রতি এক ধরনের ধোঁকাবাজিই বলা চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link