১৯৮৩ সালে কপিল দেব রামলাল নিখঞ্জের নেতৃত্বে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে বিশ্বকাপ জয় ও নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বিস্ময় প্রতিভা শচীন টেন্ডুলকারের বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করা – ক্রিকেট খেলাটাকে আপামর ক্রীড়াপ্রেমী ভারতীয়দের জীবনের রোজনামচার সাথে যুক্ত করে দিয়েছিল। ক্রিকেটাররা মানুষ নন, এমনকি সুপারহিরোর তকমা পেরিয়ে ভগবানে পর্যবসিত হয়েছিলেন।
ঠিক এমন সময়েই মেঘ ভাঙা বৃষ্টির মতো ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ আছড়ে পড়লো ভারতীয় তথা বিশ্ব ক্রিকেটের মাথার উপর। সন্দেহ, আশঙ্কার হড়পা বানে ভেসে গেল ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের প্রতি সমর্থকদের বিশ্বাস।
আর, সেই সন্ধিক্ষনেই ভারতীয় ক্রিকেটের সিংহাসনে অভিষেক ঘটলো মাত্র ৩ বছর ৮ মাস আগে ক্রিকেটের কৌলীনের গর্ভগৃহ লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে টেস্ট অভিষেকে শতরানকারী বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানটির, সৌরভ গাঙ্গুলির। কণ্টকাকীর্ণ সিংহাসনে বসে প্রথমেই অনুধাবন করলেন যে তাঁর প্রথম কাজ হবে খেলাটার প্রতি, খেলোয়াড়দের প্রতি, তাঁর দলের প্রতি সমর্থকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। আর, তার জন্য দরকার দলের খেলোয়াড়দের মানসিকতার বদল ঘটানোর। বিশেষ করে, বিদেশের মাঠে খেলার মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন ঘটানো দরকার।
শুরু হলো ‘সংস্কার’ – শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, অনিল কুম্বলে, জাভাগাল শ্রীনাথ – দলের প্রমুখ অভিজ্ঞ ‘কোর’ সদস্যদের সাথে নিয়ে নতুন প্রজন্মের নতুন প্রতিভাকে তুলে আনা। ‘টিম’ তৈরি করা।
প্রথমেই অনুধাবন করলেন পেস বোলিং বিভাগে উন্নতি না করলে আগামীদিনে বিদেশে সফল হওয়া অসম্ভব। তাই, তিনি নির্বাচকদের অনুরোধ করলেন যাতে ঘরোয়া ক্রিকেটের উদীয়মান পেসারদের বেশিদিন ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেলে না রেখে জাতীয় দলে যোগান দিতে। যার ফলস্বরূপ ঘরোয়া ক্রিকেটে স্বল্প অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ২০০০ সালে নাইরোবিতে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে জহিরের অন্তর্ভুক্তি।
বাকিটা ইতিহাস।
২০০১ সালে টানা ১৬ টা টেস্ট ম্যাচ জিতে রেকর্ড সৃষ্টিকারী স্টিভ ওয়াহ’র অস্ট্রেলিয়া যখন ভারতে এসে পৌঁছালো তখন চোটের জন্য দলের মুখ্য স্পিনার অনিল কুম্বলে দলের বাইরে। তখন তিনি একদা ‘চাকিং’ এর দায়ে অভিযুক্ত হয়ে পরবর্তীকালে অ্যাকশন শুধরে ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন ঘটানো অফ স্পিনার হরভজন সিংকে একপ্রকার জোর করেই দলে ঢোকালেন।
মুম্বাইয়ে প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পর্যদুস্ত হওয়ার পর কলকাতায় দ্বিতীয় টেস্টের আগে নির্বাচকরা এই তরুণ পাঞ্জাবি অফ স্পিনারের পরিবর্তে অপর এক পাঞ্জাবি অফ স্পিনার শরণদ্বীপ সিংকে খেলানোর জন্য চাপ দিলে, তিনি রাজি হলেন না। ঐতিহাসিক সিরিজের বাকি দুটি টেস্টেও প্রিয় ‘ভাজ্জি’কেই খেলালেন।
বাকিটা ইতিহাস।
২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে উত্তরাঞ্চলের নির্বাচক পেস বোলিং সহায়ক উইকেটে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম এই অজুহাতে জাতীয় দলে সদ্য সুযোগ পাওয়া আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান বীরেন্দ্র শেবাগকে দলে নিতে চাননি। কিন্তু, এক্ষেত্রেও নির্বাচককে হারতে হলো অধিনায়কের কাছে।
পরবর্তীকালে, ম্যাথু হেইডেন-জাস্টিন ল্যাঙ্গারের ওপেনিং জুটি যখন টেস্টেও প্রায় ৪ এর কাছাকাছি রান রেট বজায় রেখে টেস্ট ক্রিকেটের সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছেন, তখন ভারতীয় অধিনায়ক এই নতুন বিপ্লবে নিজের দলকে শামিল করার উদ্দেশ্যে ‘নজফগড়ের নবাব’-কে টেস্টে ওপেন করার জন্য বললেন, তখন দিল্লীর বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান বললেন, ‘আগার ম্যায় ফেল হো যায়ে তো ?’
অধিনায়ক বললেন, যাই হোক তুমি দলে থাকবে।
বাকিটা ইতিহাস।
অধিনায়ক হিসাবে প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকার যাওয়ার আগে থেকেই দলে একজন বিশ্বমানের ‘অলরাউন্ডার’ ও একজন ‘উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান’ যিনি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কার্যকরী ব্যাটিং করতে পারেন, এমন দুজনকে খুঁজছিলেন। ‘অলরাউন্ডার’ হিসাবে মন্দের ভালো সঞ্জয় ব্যাঙ্গারকে নিয়ে গেলেও, আরেকটা অভাব পূরণ না হওয়ায় সহ অধিনায়ককে দিয়ে কাজ চালিয়ে নিলেন।
কিন্তু, দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার আগে নির্বাচকদের কাছে এক উঠতি উইকেটরক্ষক সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু সৌরভ গাঙ্গুলিকে জানানো হলো যে ছেলেটা খড়গপুর রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট কালেক্টরের কাজে নিযুক্ত। তারপর, ২০০৪ সালে তৎকালীন ভারত অধিনায়কের দলে সেই উইকেটরক্ষক সুযোগ পেলেন।
নেটে ছেলেটার ধ্বংসাত্বক ব্যাটিং দেখে অধিনায়ক তাকে ওপেন করতে পাঠালেন। ছেলেটা ওয়াঙখেড়ে স্টেডিয়ামে আশিস নেহরাকে দুরমুশ করে বিধ্বংসী শতরান করলো। ভারতীয় ক্রিকেট মানচিত্রে আবির্ভাব ঘটালেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দেশের সফলতম অধিনায়ক – এম এস ধোনি।
বাকিটা ইতিহাস।
পরবর্তীতে, ২০১১ সালের দুই এপ্রিল দীর্ঘ ২৮ বছর পর ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে যে গৌরবজনক অধ্যায় রচনা করেছিলেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দেশের সফলতম অধিনায়ক তার মুখপত্রটা লিখেছিলেন যে বঙ্গ তনয়, তিনি তো শুধুমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক নন, বরং ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা সংস্কারক।
তাই তো যথার্থভাবেই প্রিয় ‘বীরু’ একদা বলেছিলেন, ‘Movie on Sachin Tendulkar showed the rise of Sachin. Movie on Sourav Ganguly will show rise and rise of India.’