ইউরোপ ছেড়ে সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসেরে পাড়ি জমিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। এমন খবরে তাঁর পাড় ভক্তদের মন খারাপ হতেই পারে। কিংবা ইউরোপিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়ে ঐ দাপুটে ফুটবলারটির অনুপস্থিতি একটা বিষণ্নতার রেশ অবশ্যম্ভাবী ভাবেই তৈরি করতেই পারে।
কিন্তু ফুটবল মানেই তো শুধু ইউরোপ নয়, গোটা বিশ্ব। রোনালদো হয়তো সেই গোটা বিশ্বকেই নিজের মাঝে কেন্দ্রিভূত করতে চেয়েছেন। চিরায়ত উদযাপনে মাত করতে চেয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও। একটু একটু করে বড় স্বপ্ন দেখা একটি দেশের অনুপ্রেরণার উৎস হতে চেয়েছেন। তাঁর কথার সূত্র ধরে, ইউরোপ, ব্রাজিল কিংবা আমেরিকার বেশ কিছু ক্লাবের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলেও তাঁদের ভিড়ে বেছে নিয়েছেন সৌদি আরবের একটি ক্লাবকে।
যে ক্লাবের ভিশন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রোনালদোকে দারুণ ভাবে মুগ্ধ করেছে। তাই ইউরোপে নিজের পদচ্ছাপ অঙ্কনের পর এবার সেই একই ছাপের প্রতিচ্ছবি আঁকতে ছুটে এলেন আল নাসর ক্লাবে।
রোনালদো বরাবরই এরকম। বারবার প্রতিকূলতাকে ভালবেসে কাছে টেনে নেন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নিজেকে প্রমাণের পর চলে গেলেন স্পেনে। সেখানে গিয়ে নিজেকে নিয়ে গেলেন একদম শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে গোলবন্যা বইয়ে দিলেন। সাথে একের পর এক এনে দিলেন শিরোপা। কিন্তু, তারপরও যেন তৃষ্ণা কাটে না সিআরসেভেনের। নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পাড়ি দিলেন ইতালিতে।
সেখানে জুভেন্টাসের হয়ে নিজের ছন্দ ঠিকই আঁকড়ে ধরে রাখলেন। এরপর আবার নিজের পুরনো ক্লাব ম্যানইউতে ফেরা। কিন্তু তিক্ততায় শেষ হলো সে অধ্যায়। হয়তো ঐ তিক্ততার রেশেই গোটা ইউরোপিয়ান ফুটবলই তাঁকে বিষিয়ে তুললো। তাই একদম নিজের চিরায়ত ধরনকে পুঁজি করে মাথা উঁচু করে এবার পাড়ি জমালেন সৌদি আরবে।
রোনালদোর আগমনও হলো দুর্দান্ত। একদম জমকালো আয়োজনে রোনালদোকে বরণ করে নিল আল নাসর। এ কালের অন্যতম বড় এক ফুটবল তারকার পদার্পণ। তাই আয়োজনে পূর্ণ না থেকে উপায় কই? রোনালদো সৌদিদের ভালবাসাকে কুর্নিশ জানিয়ে নিজের অভিব্যক্তিতে জানান দিয়ে দিলেন, ‘এই ভালোবাসার প্রতিদান নিশ্চিতভাবেই তারা পাবে।’
কারণ নতুন পরিবেশ ক্ষণিকের মধ্যে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় রোনালদো আজীবনই ধাতস্থ। তাই এখনকার ‘বুড়ো’ রোনালদোর ধার কিংবা প্রচেষ্টার একটুও যে ঘাটতি থাকবে না সেটিও তিনি ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন।
রোনালদো ফুটবলার, ফুটবল নিয়েই কথা বলবেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আর দশটা ফুটবলারের চেয়ে রোনালদো তো এখানেই আলাদা। আল নাসর ক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানের দিনে ফুটবল নিয়ে নিজের পরিকল্পনা অনেক কিছুই বললেন। তবে পরে যা যোগ করলেন তা কিছুটা ফুটবল বহির্ভূত, মুগ্ধ জাগানিয়া। মুসলিম বিশ্বের আতিথিয়তা নিয়ে বললেন। সৌদি আরবের তরুণ প্রজন্মদের আশু সম্ভাবনা নিয়ে কথা বললেন। এমনকি সৌদি আরবে নারীদের ফুটবল স্বত:স্ফূর্তভাবে বলে গেলেন।
ফুটবলার রোনালদো রীতিমত তখন অনুপ্রেরণার ঝাঁপি খুলে বসলেন। এমন রোনালদোতে ততক্ষণে স্টেডিয়ামের সবাই মুগ্ধ, কিছুটা আপ্লুতও। এমন এক বড় তারকা মধ্যপ্রাচ্যের এমন একটা দেশে যে কথাগুলো বললেন তা শেষ কবে কেউ বলেছে তা খুঁজে বের করতেও বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে। রোনালদো বোধহয় এ কারণেই অনন্য। সেটা তিনি নিজেও জানেন। তাই নিজেও রাখঢাক না রেখেই বললেন, ‘আল নাসের ইউনিক ক্লাব। আমিও ইউনিক ফুটবলার।’
রোনালদোর জন্য গোটা সৌদি আরব দেশটাই যে জনস্রোতে পরিণত হয়েছিল তা সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই তটস্থ করতে একটুও বেগ পেতে হয় না। আল নাসররের কোচ রুডি গার্সিয়াও তা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত। গণমাধ্যমের সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলে ফেললেন, ‘সৌদিতে আমি এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি। যেখানে লিগ ম্যাচের পর মাত্র ৩/৪ জন সাংবাদিক দেখা যায় সেখানে আজকের এ অনুষ্ঠানে এসেছে শত শত সাংবাদিক। এটা রোনালদোর জন্যই সম্ভব হয়েছে।’
দ্য রোনালদো ইফেক্ট বুঝি একেই বলে। রোনালদো আল নাসরে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত ক্লাবের ইন্সটাগ্রাম ফলোয়াড় এক মিলিয়নও স্পর্শ করেনি। কিন্তু রোনালদো আল নাসরে আসছেন শুনেই একদম বিদ্যুৎ গতিতে বাড়তে থাকলো ফলোয়ার সংখ্যা।
এক মিলিয়ন, দুই মিলিয়ন করে টেক্কা দিয়ে ফেলল ইউরোপের নামী বেশ কিছু ক্লাব গুলোকে। এই মুহূর্তে আল নাসরের ইন্সটাগ্রাম ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় ১০ মিলিয়ন। অথচ দিন পাঁচেক আগেও তা এক মিলিয়নেরও কম ছিল। দিনশেষে রোনালদো যে সমগ্র বিশ্বের একটি ব্র্যান্ড সেটিই যেন প্রমাণিত হলো।
রোনালদোকে নিয়ে ক্লাব কিংবা সমর্থকদের এমন উন্মাদনা নতুন কিছু নয়। জুভেন্টাসে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হলেন তখনও ইন্সটাগ্রাম ফলোয়ার সংখ্যায় তরতর বেড়ে উঠছিল জুভেন্টাসের অফিশিয়াল অ্যাকাউন্ট। একই সাথে ভক্তদের সিআরসেভেনের ৭ নম্বর জার্সি কেনা নিয়ে সে সময় এক প্রকার হট্টগোলই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমন সব দৃশ্যে সে সময় ইতালির এক টেলিভিশন চ্যানেল তো আখ্যাই দিয়ে দিল যে, এটাই শতাব্দীর সেরা চুক্তি।
জুভেন্টাসের আর্থিক সফলতায় রোনালদোর প্রভাব কেমন ছিল তা স্পষ্ট হবে আরেকটি দিকে একটু মনযোগ দিলে। রোনালদো আসার আগে জুভেন্টাস প্রায় ৪০ মিলিয়ন ইউরোর ক্ষতিতে নিমজ্জিত ছিল। কিন্তু রোনালদো আসতেই যেন বদলে গেল চিত্রটা। ঠিক এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ইউরোর লাভের মুখ দেখে জুভেন্টাস।
এমনকি রোনালদো যখন জুভেন্টাস ছেড়ে আসেন তখনও দুই পক্ষের লাভের ভিত্তিতেই দলবদল সম্পন্ন হয়। মূলত রোনালদো কখনোই ক্যারিয়ারে কোনো ক্লাবের জন্য বোঝা হয়ে থাকেননি। ম্যানইউ এর সাথে তাঁর দ্বিতীয় অধ্যায় বাদ দিলে প্রতিটি ক্লাবকেই তিনি শিরোপা দিয়ে একেবারে মুড়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি আর্থিকভাবেও সে সব ক্লাবের দুর্দান্ত অবস্থায় যাওয়ার নেপথ্যের নায়ক ছিলেন এই রোনালদো।
রোনালদো সৌদি আরবের যে অর্থ আর বিলাসী আবরণে মুড়ে থাকবেন সেটি বোধহয় এখন না বললেও চলছে। আল নাসরের সাথে চুক্তির পর এই মুহূর্তে রোনালদো বিশ্বের সবচেয়ে দামি ক্রীড়াবিদ। ফোর্বস বলছেন, এখন থেকে প্রতি বছর রোনালদো ২১ কোটি মার্কিন ডলার আয় করবেন। যা বর্তমানে পিএসজি’র হয়ে লিওনেল মেসির আয়ের প্রায় ৫ গুণ।
২০২২ সালে নিজের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপে ভাল কাটেনি রোনালদোর। বিশ্বকাপ তাই বড় এক আক্ষেপের বস্তু হয়ে রইল তাঁর জন্য। তবে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে থাকা ব্যাপারটা রোনালদোর মাঝে কখনোই ছিল না। বয়সকে স্রেফ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একদম নিজের মতো করে চলা, নতুন এক সংজ্ঞা তৈরি করা রোনালদো একটা সাধুবাদ পেতেই পারেন। কারণ রোনালদো ঐ ফুটবল পায়ে দৌড়াচ্ছেন, ততদিন যে তাঁর পরিহিত জার্সির ক্লাবটাও দৌড়াতে থাকবে। একেই তো বলে দ্য রোনালদো ইফেক্ট!