২০১২ সালে ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে ক্রোয়াট মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচকে দলে টেনে ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। এর পরের বছরই আবারো একই ক্লাব থেকে রেকর্ড ১০০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে লিকলিকে গড়নের এক উইঙ্গারকে সাইন করায় স্প্যানিশ জায়ান্টরা। তিনি ওয়েলস তারকা, বিবিসি ত্রয়ীর অন্যতম সদস্য – গ্যারেথ বেল।
মূলত নেইমার জুনিয়রকে বার্নাব্যু-তে আনতে না পারায় গ্যারেথ বেলকে কিনেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। নেইমারের ট্রান্সফার ব্যর্থতা ঢাকতে ২০১৩ সালে সদ্য বিদায়ী মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার জেতা গ্যারেথ বেলকে স্পেনে নিয়ে আসেন রিয়াল সভাপতি। তবে মাদ্রিদ সমর্থকরা খুব একটা কাছে টেনে নিতে পারেনি অপ্রত্যাশিত বেল’কে। নেইমারকে কিনতে না পারার চাপা অভিমান হয়তো বেলকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
তবে মাদ্রিদ ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই ভক্তদের হৃদয় জয় করতে শুরু করেন বেল। করিম বেনজেমা আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে গড়ে তোলেন বহুল পরিচিতি বিবিসি ত্রয়ী। ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭ আর ২০১৮ এই চার বছর চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিল রিয়াল মাদ্রিদ আর যেখানে সরাসরি অবদান রেখেছিলেন গ্যারেথ বেল। এর মাঝে ২০১৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে বেলের অতি মানবীয় পারফরম্যান্স কেইবা ভুলতে পারবে।
শুধু কি ২০১৮ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে করা গোল দুইটি নয়, গ্যারেথ বেলের পা থেকে এসেছে আরো অনেক শৈলীময় গোল। বিশেষ করে কোপা দেল রে টুর্নামেন্টের ফাইনালে বেল যেন বিদ্যুৎ হয়ে উঠেছিলেন। মধ্যমাঠ থেকে এক দৌড়েই বার্সেলোনা’র গোলরক্ষককে পরাস্ত করেছিলেন তিনি। আর এতটাই জোরে দৌড়েছিলেন যে, তার মার্কার মার্ক বার্ত্রাকে নিয়ে রীতিমতো ট্রল শুরু হয়েছিল।
সব মিলিয়ে নিজের গতি আর পায়ের কারুকাজে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে অনেকবারই মনে রাখার মত মূহুর্ত সৃষ্টি করেছিলেন বেল। কিন্তু সর্বনাশা ইনজুরি আঘাত হানে সম্ভাবনাময়ী এক ক্যারিয়ারে। দোষটা অবশ্য বেলের। তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল গতি, আর তাই পায়ের পেশীর প্রতি থাকতে হতো বাড়তি সতর্কতা।
কারণ, দৌড়ের সময় একটু এদিক-ওদিক হলেই ইনজুরিতে পড়তে হয়। কিন্তু মাদ্রিদে আসার পরেই বেল হঠাৎ বডি বানাতে চাইলেন। এতদিন লিকলিকে শরীরের বেলের ভর বহনে সমস্যা হয়নি তার পায়ের, কিন্তু ওজন বাড়ার পরে শুরু হয় সমস্যা। আর সেখান থেকে ইনজুরি, ধীরে ধীরে বেল হয়ে পড়েন অধারাবাহিক।
সেখানেই শেষ নয়, ২০১৯ সালে তার দেশ ওয়েলস ইউরোর টিকিট কাটার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেল লিখেছিলেন, ‘ওয়েলস, গলফ, মাদ্রিদ’। তাতেই চটে যায় মাদ্রিদ সমর্থক আর স্প্যানিশ গণমাধ্যম। তাদের মতে, বেলের প্রাধান্যের তালিকায় মাদ্রিদের অবস্থান তৃতীয়তে।
ইনজুরি, ভক্তদের দুয়োধ্বনি আর কোচের অনাগ্রহ – সব মিলিয়ে এক সময় আড়ালে চলে যান গ্যারেথ বেল। হারিয়ে ফেলেন মাদ্রিদের হয়ে ফুটবল খেলার আগ্রহ। শেষ কয়েক বছর তো সাদা জার্সি গায়ে দেখাই পাওয়া যেত না তার। অথচ, রোনালদোর বিদায়ের পরে বেলের উপরই সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছিল রিয়াল মাদ্রিদ।
ভরসার বিপরীতে শূন্য হাতেই ফিরতে হয়ে মাদ্রিদিস্তাদের। ২০১৮ থেকে ২০২২, এই চার বছর রোনালদোর অনুপস্থিতিতে বলার মত কিছুই করতে পারেননি বেল। এই বছরের জুনে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে তার, অনেকটা চুপিসারেই বিদায় নিচ্ছেন তিনি।
অবশ্য এত কিছুর পরেও লস ব্ল্যাঙ্কোসদের হয়ে গ্যারেথ বেলের অর্জন নেহায়েত কম নয়। রোনালদো লিমার মত সর্বকালের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারের চেয়ে গোল সংখ্যা বেশি বেলের। ব্ল্যাঙ্কোসদের হয়ে রোনালদো লিমার গোল যেখানে ১০৪টি সেখানে বেলের গোল ১০৬। এছাড়া অ্যাসিস্টের হিসেবে আরেক ইংলিশ সুপারস্টার ডেভিড বেকহামকে পিছনে ফেলেছেন ওয়ালসম্যান।
বেকহামকে ৫১টি অ্যাসিস্টের বিপরীতে গ্যারেথ বেলের ঝুলিতে আছে ৬৭টি অ্যাসিস্ট। অন্যদিকে, ট্রফির দিকে তাকালে দেখা যায় জিনেদিন জিদানের চেয়েও বেশি শিরোপা জিতেছেন গ্যারেথ বেল। না, এদের কারো সাথেই তুলনা দেয়া হয়নি তার, শুধুই তুলে ধরা হয়েছে পরিসংখ্যান।
আর তাই, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে যা করেছেন গ্যারেথ বেল, সেটি সামান্য বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এত এত বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও অস্বীকার করা যায় না তাকে। অল হোয়াইটদের ইতিহাসই বারবার খুঁজে নেয়, নিবে ওয়েলস ড্রাগনকে।
তারপরও গ্যারেথ বেলকে নিয়ে ভক্তরা দুইভাগে বিভক্ত; কারো কাছে বেল একজন রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি আবার কারো মতে, তিনি মাদ্রিদ পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান, যিনি কখনোই হৃদয়ে ধারণ করতে পারেনি মাদ্রিদিজমকে। রিয়াল থেকে তাঁর বিদায় সুখকর না হলেও তিনি ঠিকই ওয়েলসকে বিশ্বকাপে নিয়ে যেতে পেরেছেন, নিজের দেশকে এনে দিতে পেরেছেন উৎসবের উপলক্ষ্য।