মুজিব উর রহমান যখন নিজের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্পটা বলছিলেন, ক্রাইস্টচার্চের সুরম্য হোটেলে বসেও সেটা শুনতে বেমানান ঠেকছিল না। শীর্ষ পর্যায়ে খেলা আর দশজন আফগান ক্রিকেটারের সংগ্রামের গল্পটা অনেক সময়েই পাঁচ তারকা হোটেলের আভিজাত্যের মধ্যে থেকে বোঝা শক্ত। মুজিবের ক্ষেত্রে সেটা হল না, কারণ তাঁর উঠে আসার গল্পটা একটু ভিন্ন!
তিনি আক্ষরিক অর্থেই প্রাসাদে বড় হয়েছেন। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ‘হাভেলি’। রাজধানী কাবুলের দক্ষিণ-পূর্বে ২৫০ কিলোমিটার দূরের ‘খোস্ত’ শহর। সেখানেই মুজিবদের বাড়ি, মানে প্রাসাদ। মুজিব বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে বিশাল একটা খেলার মাঠ, এক গাদা গেস্ট হাউজ, এমনকি ছোট্ট একটা চিড়িয়াখানাও আছে।’
এখানেই শেষ নয়, সেখানে ক্রিকেট খেলার জন্য আধুনিক মানের ব্যবস্থাও আছে। সেটার নাম ‘নূর ক্রিকেট অ্যাকাডেমি’। বানিয়েছিলেন মুজিবের কাজিন ও আফগান জাতীয় দলের ক্রিকেটার নূর আলী জাদরান।
সদ্য কৈশোর পার করা মুজিব বলেন, ‘আমি খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারাই। বড় হই মামার বাড়িতে।’
নিজের আঙিনাতে ক্রিকেট খেলার এত ভাল বন্দোবস্ত থাকার পরও ২০১২ সালের বিশ্বকাপ দেখার আগ অবধি ক্রিকেটের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালবাসা ছিল না মুজিবের। সেই বিশ্বকাপে আফগানদের প্রতিটি ম্যাচ দেখার পর উঠোনে চলে যেতেন। টেনিস বল দিয় বাড়ির অন্যান্য শিশুদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন।
সেই থেকে শুরু। মুজিব বলেন, ‘একটু একটু করে আমি নূর অ্যাকাডেমিতে যাওয়া শুরু করি। ওখানেই আমার পুরোদস্তর ট্রেনিং শুরু হয়। তখন বয়স ছিল ১১ কি ১২ বছর। খেলাটা ভালভাবে বুঝে ওঠার পর, আমি খোস্ত প্রোভিন্স অ্যাকাডেমিতে যাওয়া শুরু করি।’
ওই সময় থেকেই আঙুল দিয়ে টেনিস বল ঘোরানোর অভ্যাস ছিল মুজিবের। সেটাই ধীরে ধীরে তার মধ্যে স্পিন বোলিংয়ের প্রতি প্যাশনের সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, ‘আমি টেনিস বলের ওপর টেপ লাগিয়ে এক সময় প্রচুর ক্রিকেট খেলেছি। খেয়াল করলাম এটা প্রচুর স্কিড করে। তাই আঙুল দিয়ে বল ঘোরানোর চেষ্টা করতাম। এরপর আমি ইউটিউবে অজন্তা মেন্ডিসের (শ্রীলঙ্কান রহস্য স্পিনার) ভিডিও দেখে বল গ্রিক করা আর মধ্যাঙ্গুলি দিয়ে ঘোরানোর কৌশল শিখি। প্রথম যখন বোলিং শুরু করি, তখন শুধু ফ্লাইটের ওপর জোর দিতাম, জোর দেওয়ার চেষ্টা করতাম না। এটা অনেকটা ফ্লাইটেড অফ স্পিনের মত হল। এরপর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করে আঙুলের জোর বাড়াই।’
এখন আফগানিস্তান অনূর্ধ্ব ১৯ দলের সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন খালেদাদ নূরি। যেবার রাজ্য দলের ক্যাম্প চলাকালে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর সিনিয়র ব্যাটসম্যানদের ক্রমাগত ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছিল তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
স্মৃতি হাতরে তিনি বলেন, ‘একটা ক্যাম্পের কথা মনে আছে যখন ও বল করছিল। আমি ছিলাম আম্পায়ার। ওটা ছিল জাতীয় দলের একটা প্রস্তুতি ম্যাচ। আমার মনে আছে ও একাই ছয়টা উইকেট নিয়েছিল। ওর বৈচিত্রময় বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানরা মার খেয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। ওর মধ্যে উপরওয়ালা প্রদত্ত প্রতিভা আছে। ও প্রচুর আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের আঙুল গুলোকে শতভাগ কাজে লাগায়।’
রাজ্য দলের ক্যাম্পে দারুণ করার পরও মুজিব সেবার অনূর্ধ্ব ১৬ দল থেকে বাদ পড়েন। এরপর ফিরেন নিজের হাভেলিতে। তাদের পারিবারিক মিলনমেলাতেও জায়গা পেত ক্রিকেট। এমনই এক মিলনমেলায় নতুন এক ডেলিভারির ব্যাপারে তিনি জানতে পারেন, নতুন এক অস্ত্র যোগ হয় মুজিবের ঘূর্ণি অস্ত্রশালায়।
মুজিব বলেন, ‘আমাদের পরিবারটা অনেক বড়। সবাই কম-বেশি ক্রিকেটের সাথেই আছে। একদিন আমি একজনের বিপক্ষে ব্যাট করছিলাম। দেখলাম তিনি এমন ভাবে বল করছেন, যাকে খালি চোখে লেগ স্পিন বলে মনে হলেও আসলে সেটা অফস্পিনের মত বাঁক নিচ্ছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিভাবে করলে? ও আমাকে শেখালো কিভাবে বলকে হাতের ভেতরে আড়াল করে রেখেও ঘোরানো যায়। আমি সেই ডেলিভারিটা শিখলাম, আর নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেটা অনুশীলন করা শুরু করলাম।’
বাকিটা ইতিহাস, গুগলি, ক্যারম বল আর জেনুইন অফ ব্রেক ডেলিভারি দিয়ে গোটা আফগানিস্তানেই মুজিবকে নিয়ে মাতামাতি হল। দারুণ পারফরম্যান্সের সুবাদে তিনি অনূর্ধ্ব ১৬ টুর্নামেন্ট থেকে সোজা জায়গা করে নিলেন অনূর্ধ্ব ১৯ দলে।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে যুব ক্রিকেটে অভিষেকেই ২৪ রান দিয়ে পেয়েছিলেন চার উইকেট। বাংলাদেশের মাটিতে গত বছর দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলে গেছেন। পেয়েছেন ১৭ টি উইকেট। অনূর্ধ্ব ১৯ এশিয়া কাপে মালয়েশিয়ায় তার ঝুলিতে যোগ হয়েছে ২০ টি উইকেট। দলকে শিরোপা এনে দেওয়ার পেছনে বড় অবদান তার।
তখন থেকেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) দলগুলোর নজর ছিল তাঁর ওপর। একটা দলের স্কাউটরা তাঁকে খেলার জন্য প্রস্তাবও করে বসে। এরপর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স দলেও নাম লেখান।
মুজিব বলেন, ‘ওই ঘটনা আমার আত্মবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দেয়। আমি খুব খুশি ছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল ভাল কিছু করে দেখাতে পারলে আমি আরো এগিয়ে যেতে পারবো।’
যুব বিশ্বকাপের মঞ্চেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি। ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪ রানে চার উইকেট নিয়ে দলকে সেমিফাইনালে পৌঁছে দেওয়ার পথে রেখেছেন বড় ভূমিকা। বড় বিস্ময়টা তখনও অজানাই ছিল। রীতিমত আইপিএলের দলে জায়গা হয়ে যায় তাঁর।
মাত্র ১৬ বছরের এক তরুণের আর কিই বা চাই! আর এখন তিনি নিয়মিত বিশ্বজুড়ে প্রায় সবধরণের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটই খেলে বেড়ান। রশিদ খানের পর আর যে স্পিনারকে ঘিরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে আফগানিস্তান তিনি হলেন এই মুজিব।
যার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সব কিছুই হয়েছে প্রাসাদতুল্য এক বাড়িতে তাঁর জন্যও অর্থের এই অংকটা বিশাল এক ব্যাপার। সবচেয়ে কমবয়সী আফগান ক্রিকেটার হিসেবে আইপিএলে নাম লিখিয়ে এরই মধ্যে তিনি ইতিহাস বনে গেছেন। দেশের ক্রিকেটেও তিনি বিরাট এক ইতিহাসের নাম।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৯ রান দিয়ে নিয়েছেন পাঁচ উইকেট। ছোট ফরম্যাটের বিশ্বমঞ্চে আফগানদের হয়ে এটা যে কারো সেরা বোলিং পারফরম্যান্স। আর বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটা পঞ্চম সেরা বোলিং। আর কি কি ইতিহাস তিনি গড়বেন সেটা দেখার জন্য তাহলে মাঠের খেলায় নজর রখা যাক।
আফগান ক্রিকেটারদের প্রচলিত জরা, দারিদ্র জর্জজিত স্টেরিওটাইপ সংগ্রামের গল্পটা তিনি আগেই পাল্টে ফেলেছেন, এবার মিশন মাঠের গল্পটা পাল্টে ফেলার!