হৃদয়বান অতন্দ্র প্রহরী

ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের গোলরক্ষক তিনি। তাকে নিয়ে গর্ব করে রিয়াল মাদ্রিদ ভক্তরা। না, অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড বাহুতে বেঁধে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ের আভিজাত্য রক্ষা করা ইকার ক্যাসিয়াসের কথা বলা হয়নি। বলা হয়নি অল হোয়াইটদের টানা তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানো কেইলর নাভাসের কথা। এই গল্পটা থিবো নিকোলাস মার্ক কোর্তোয়া’র, যিনি প্রতিনিয়ত প্রতিপক্ষের দুর্ধর্ষ আক্রমণ থেকে আগলে রাখেন লস ব্ল্যাঙ্কোসদের।

এই গোলকিরক্ষকের জন্ম ১৯৯২ সালের ১১ই মে, বেলজিয়ামের ব্রি-তে। ১৯৯৭–৯৮ মৌসুমে বেলজীয় ফুটবল ক্লাব বিলজেনের যুব পর্যায়ের হয়ে খেলার মাধ্যমে কোর্তোয়া ফুটবল জগতে প্রবেশ করেন। এরপর ক্লাব খেংকের যুব দলের হয়ে খেলার মাধ্যমে নিজেকে করেছেন আরো শানিত। ২০০৮–০৯ মৌসুমে খেংকের মূল দলের হয়ে খেলার মাধ্যমে সিনিয়র পর্যায়ে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয় তাঁর। খেংক ক্লাবে ৩ মৌসুম কাটানো কোর্তোয়া ততদিনে ৪৫ ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

অতঃপর ২০১১–১২ মৌসুমে থিবো কোর্তায়াকে ৯ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইংলিশ ক্লাব চেলসি কিনে নেয়। অবশ্য একই মৌসুমে তাকে ধারে স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাটলেতিকো মাদ্রিদে পাঠানো হয়। কারন তৎকালীন সময়ে চেলসি স্কোয়াডের নাম্বার ওয়ান গোলরক্ষক ছিলেন কিংবদন্তি পিটার চেক। আর তাই এই লোন ট্রান্সফার কোর্তোয়ার জন্য আশীর্বাদই ছিল বটে। পর্যাপ্ত প্লেয়িং টাইম পাওয়া সহজ হয়ে যায় তাঁর জন্য।

রোজিব্ল্যাংকোসদের হয়েই প্রথম ইউরোপীয় ফুটবলে অভিষেক ঘটে কোর্তোয়ার। অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদের হয়ে ১৯ বছর বয়সে ইউরোপা লিগে মাঠে নামেন এবং তার তিনদিন পর লা লিগায়। উভয় ম্যাচেই ক্লিন শিট রেখে নিজের আগমনী বার্তা দেওয়ার কাজ ভালভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন থিবো কোর্তোয়া। প্রথম মৌসুমেই ইউরোপা লিগ আর পরের মৌসুমে উয়েফা সুপার কাপ এবং স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতে নেন কোর্তোয়া।

তাছাড়া ২০১৩-১৪ মৌসুমে লা লিগা জয়ের স্বাদও আস্বাদন করেন। দিয়েগো সিমিওনে এর অধীনে অ্যাটলেতিকো মাদ্রিদে কাটানো ৩ মৌসুমে কোর্তোয়া সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে জিতেন ৪টি ট্রফি। এছাড়া বিখ্যাত লা ডেসিমার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে অ্যাতলেতিকোর গোলবার রক্ষা করার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। যদিও ভাগ্যের সুদৃষ্টির অভাবে সেবার ছুঁতে পারেননি রূপালি সেই ট্রফি।

তিন মৌসুম স্পেনে কাটানোর পর ইংল্যান্ডের চেলসিতে ফিরে আসেন কোর্তোয়া। ২০১৮ পর্যন্ত চেলসিতেই কাটানো থিবো কোর্তোয়া ব্লুজদের হয়ে দুইবার প্রিমিয়ার লিগ জেতার স্বাদ পেয়েছেন, এছাড়াও এফএ কাপ এবং লিগ কাপের শিরোপা উদযাপন করেছেন তিনি।

২০১৮–১৯ মৌসুমে থিবো কোর্তায়াকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে চেলসি থেকে নিজেদের ডেরায় ভেড়ায়। কোর্তোয়া খেলার সুযোগ পেয়ে যান অ্যাতলেতিকো ও রিয়াল; দুই নগর প্রতিদ্বন্দ্বির হয়েই। নতুন ক্লাবে শুরুটা অবশ্য সুখকর হয়নি, নিজের ক্লাবভক্তদেরই পাশে পাননি কোর্তোয়া। তৎকালীন ত্রিপিটজয়ী গোলরক্ষক কেইলার নাভাসকে রিপ্লেস করাটা সহ্য হয়নি অনেকের। এমনকি ক্লাব ম্যানেজম্যান্টের ভরসার প্রতিদান দেয়ার মতো কিছুই করতে পারেননি কোর্তোয়া। বরং প্রতি ম্যাচেই কিছু অমার্জনীয় ভুল তাকে সমালোচনার কেন্দ্রে পরিনত করেছিল।

তবে বদলেছে সময়, বদলেছে মাদ্রিদিস্তাদের মনোভাব। দুটো এল ক্ল্যাসিকো আর মাদ্রিদ ডার্বিতে ক্লিনশিট, সুপার কাপে পেনাল্টি-শুটআউটে নায়কোচিত পারফরম্যান্স; একটু দেরীতে হলেও মাদ্রিদিস্তাদের মনে জায়গা করে নেন থিবো। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে অভিষেক সিজনের প্রথম দশ ম্যাচেই তার ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলো অনেকে। কিন্তু সেই ধ্বংসস্তুপ থেকেই ফিনিক্স পাখির মত ফিরে এসেছেন থিবো। গোলপোস্টের সামনে রীতিমতো অতন্দ্র প্রহরী হয়ে উঠেছেন তিনি।

এখন প্রতি ম্যাচের প্রতিটা সেভেই হয়তো তার প্রতি মাদ্রিদিস্তাদের ক্ষমাপ্রার্থনা থাকে, থাকে কৃতজ্ঞতা। এখন পর্যন্ত অল হোয়াইটদের জার্সি গায়ে দুইটি লা-লিগা, দুইটি স্প্যানিশ কাপ এবং একটি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছেন এই বেলজিয়ান গোলরক্ষক।

আলোর অন্য পাশেই তো অন্ধকার। দুইটি প্রিমিয়ার লিগ আর তিনটি লা লিগা জিতলেও এখনো স্বাদ পাননি সবচেয়ে ক্লাব ক্যারিয়ারে মর্যাদাপূর্ন ট্রফি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার। অবশ্য ২০১৪ এর পর আবারো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠেছেন থিবো কোর্তায়া। এবার হয়তো জিততে চাইবেন আরাধ্য সেই রূপালি ট্রফি।

এছাড়া নিজ দেশের সোনালী প্রজন্মের অংশ হয়েও জিততে পারেননি বড় কোন শিরোপা। বিশ্বকাপ কিংবা ইউরো’র মত টুর্নামেন্টে বারবার খালি হাতে ফিরেছে ‘ইউরোপের ব্রাজিল’ খ্যাত বেলজিয়াম। ২০১৮ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলেরই বিপক্ষে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স দেখিয়ে থিবো কোর্তায়া দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেমিফাইনালে। তবে বিশ্বকাপ যাত্রা থামাতে হয়েছিলো সেখানেই। অবশ্য দল সেমির বাধা টপকাতে না পারলেও সেই বিশ্ব আসরে গোল্ডেন গ্লাভস জিতে নিজেকে প্রমান করেছিলেন তিনি।

ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা এই গোলরক্ষক শুধু গ্লাভস হাতেই মাঠে খেলেন না। খেলেন হৃদয় দিয়ে, নিজের সবটুকু উজাড় করে দেন দলকে বিপদমুক্ত করার জন্য। আরেক স্প্যানিশ ক্লাব সেল্টা ভিগো’র অধিনায়ক ইগো আসপাস তো বলেই দিয়েছেন থিবো কোর্তায়াকে পরাস্ত করতে অতিমানবীয় কিছু করতে হবে। আর এই মনোমুগ্ধকর ফর্ম ধরে রাখতে পারলে নিশ্চিতভাবেই রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে কিংবদন্তি হিসেবে স্থান পাবেন থিবো কোর্তায়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link