সত্য প্রকাশের অবাধ্য সাহস

বার্বাডোজের ব্রিজটাউনের মাঠ কেনসিংটন ওভালের প্রেসবক্সের নামকরণ করা হয়েছিল তাঁর নামে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটে তিনি ছিলেন বড় ব্যাপার। একগাদা গ্রেট ক্রিকেটারের জন্ম যে অঞ্চলে সেখানে তিনি নিজের আলাদা একটা অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল, ক্রিকেটের যেকোনো বিষয়ে অথোরিটি নিয়ে বলতে বা লিখতে পারতেন তিনি। তিনি ছিলেন সত্য প্রকাশের অবাধ্য সাহস।

না, তাঁকে ঠিক ক্রিকেটার বলা যায় না। কৈশোর পেড়িয়ে টুকটাক ক্লাব ক্রিকেট খেলেছেন বটে – তবে সেসব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। অন্তত, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে – কিংবা নিদেনপক্ষে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান কখনো মাঠে নামেননি।

তারপরও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটে, কিংবা বিশ্ব ক্রিকেটে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র, ক্রিকেটের অনবদ্য এক কষ্ঠস্বর চির স্মরণীয় একটি নাম – টনি কোজিয়ার। পুরো নাম উইন্সটন অ্যান্থনি লয়েড কোজিয়ার। ২০১৬ সালের ১১ মে যখন তাঁর জীবনের খাতায় ‘স্টাম্পস’ লেখা হয়ে যায় – তখন তাঁর ক্রিকেট সাংবাদিকতা জীবনের বয়স ৫৮ বছর। অবশ্যই তিনি ক্রিকেট সাংবাদিকতার শেষ কথা।

১৯৪০ সালের ১০ জুলাই বার্বাডোজের ব্রাইটনে তাঁর জন্ম। কোজিয়ার মাত্র ২৬ বছর বয়সেই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম বিবিসির হয়ে টেস্ট ম্যাচ কভার করেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখি ও ধারাভাষ্য অবশ্য দিতেন এর আগে থেকেই। মাত্র ১৮ বছর বয়স থেকে।

সাংবাদিকতা ছিল তাঁর রক্তে। বাবা জিমি নিজেও ছিলেন সাংবাদিক। ছেলেরও ঝোঁক ছিল সেদিকে। কানাডার অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় উচ্চশিক্ষা নেন। একই সাথে মাঠের খেলাধুলার সাথেও জড়িত ছিলেন। বার্বাডোজের হকি দলের গোলরক্ষক ছিলেন। বার্বাডোজের দুই ক্লাব – ওয়ান্ডারার্স ও কার্লটনের ওপেনিং ব্যাটসম্যানের ভূমিকায়ও দেখা গেছে তাঁকে। সাথে দাঁড়াতেন উইকেটের পেছনেও।

১৯৬৬ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট সিরিজ চলাকালে সর্ব প্রথম তিনি ধারাভাষ্যে আসেন। এরপর পাঁচটা দশক তিনি নিজের কণ্ঠে মোহাবিষ্ট করে রাখেন ক্রিকেট বিশ্বকে। স্রেফ ধারাভাষ্যকার কিংবা ক্রিকেট সাংবাদিকের পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্রিকেট পণ্ডিত।

তিনি ছিলেন ‘মাস্টার অব অল ট্রেড’। টেলিভিশন কিংবা রেডিওতে ধারাভাষ্য দিয়েছেন, পত্রিকায় লিখেছেন, বই বের হয়েছে তাঁর নামে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আধুনিক ডিজিটাল মিডিয়াতে কাজ করেছেন। একজন ক্রিকেট সাংবাদিক হিসেবে যা যা করা সম্ভব তাঁর সবকিছুতেই সর্বোচ্চ চূড়া ছুঁতে পেরেছেন তিনি।

বার্বাডোজের ব্রিজটাউনের মাঠ কেনসিংটন ওভালের প্রেসবক্সের নামকরণ করা হয়েছিল তাঁর নামে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটে তিনি ছিলেন বড় ব্যাপার। একগাদা গ্রেট ক্রিকেটারের জন্ম যে অঞ্চলে সেখানে তিনি নিজের আলাদা একটা অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল, ক্রিকেটের যেকোনো বিষয়ে অথোরিটি নিয়ে বলতে বা লিখতে পারতেন তিনি। তিনি ছিলেন সত্য প্রকাশের অবাধ্য সাহস।

২০১৬ সালে এসে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে গেলেন তিনি। বার্বাডোজের একটা হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিন মে। সেখান থেকে আর ফেরা হল না। ১১ মে বিদায় জানালেন পৃথিবীকে। রেখে গেলেন নিজের ক্রিকেট ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের পতাকা নিয়ে এখন চলছেন ছেলে ক্রেইগ কোজিয়ার যিনি নিজেও একজন ক্রিকেট সাংবাদিক।

লেখালেখি-ধারাভাষ্যকারে জীবনে বিবিসি, চ্যানেল নাইন, স্কাই স্পোর্টস কিংবা ইএসপিএন ক্রিকইনফোর মত মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। টনি কোজিয়ার কত বড় কিংবদন্তি ছিলেন এটা বুঝতে দু’টো তথ্যই যথেষ্ট – ২০১১ সালে তিনি মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) সম্মানজনক আজীবন সদস্যপদ পান।

বিশ্বের অনেক কুতুব ক্রিকেটারও এই সম্মান পান না। তাই তার প্রতি গোটা ক্রিকেট বিশ্বের সাংবাদিক মহল নি:সন্দেহে কৃতজ্ঞ থাকবেন। এমনি এমনি তো আর তাঁর ক্রিকেট সাংবাদিকতার শেষ কথা বলছি না।

ইএসপিএন ক্রিকইনফোর এডিটর ইন চিফ সম্বিত বাল বলেছিলেন, ‘তিনি এই খেলাটাকে এত বেশি দিয়ে গিয়েছিলেন যে নি:শঙ্কোচে বলা যায় যে তাঁর জায়গা কেউ কখনো তিনি পারবে না।’ না, কথাটা একেবারেই বাড়িয়ে বলা নয়!

গ্রেট ফাস্ট বোলার মাইকেল হোল্ডিং বলেন, ‘তিনি এমন একজন যিনি ক্রিকেটকে ভালবাসতেন। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে অনুসরণ করতে ধর্মের মত। মন থেকে যেটা বিশ্বাস করতেন – সেটাই বলতেন। তাতে কে কি ভাবলো তাতে কোনো পরোয়া করতেন না। তিনি খেলাটার প্রতি সৎ ছিলেন। যা লিখতেন বা বলতে সততার সাথে বলতেন – সাহসের সাথে বলতেন!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...