আবাহনী মাঠ তখনও পুরোদস্তুর স্টেডিয়াম। নিয়মিত প্রথম শ্রেণি খেলা হয়। সেখানেই কী একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ চলছিলো।
আকাশে তখন ঘোরতর দূর্যোগের কবলে পড়েছে একটি হেলিকপ্টার। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এলোমেলো উড়ছে চপারটি। অবশেষে পাইলট কোনোক্রমে রক্ষা করে হেলিকপ্টারটিকে আবাহনী মাঠেই নামালেন। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
পাইলট তখনও নিশ্চয়ই ঘামছেন। মাত্রই মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখে এসেছেন। তিনি নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তার আগেই দীর্ঘদেহী এক আম্পায়ার জোর পায়ে হেটে এসে সামনে দাড়ালেন। পাইলটকে লক্ষ করে তর্জন করে উঠলেন, ‘হেই, মিস্টার পাইলট, আর ইউ স্টুপিড?’
পাইলট হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না কী বলবেন।
আম্পায়ার আরও চটে উঠে বললেন, ‘ইউ ডোন্ট নো, দেয়ার ইজ আ ‘লিস্ট এ’ ম্যাচ গোয়িং অন?’
দিস ইস নাদির শাহ। ক্রিকেট, ক্রিকেট এবং ক্রিকেটই যার একমাত্র জগত ছিলো, সেই নাদির শাহ।
একজন পাইলটের কাছে যে ক্রিকেটের সূচী থাকার কথা নয়, সূচী দেখে যে তিনি দূর্ঘটনায় পড়তে পারেন না; এসব তার চিন্তায়ই থাকতো না। তার চিন্তা জুড়ে কেবলই ক্রিকেট। তার ধারণার জগত ছিলো, সকলেই ক্রিকেট বোঝে এবং বোঝা উচিত। এই হলেন নাদির শাহ।
নাদির শাহর উপস্থিতি মানেই বিনোদন।
দাতে দাত চেপে ব্রিটিশ ইংরেজিতে কথা বলা, কথায় কথায় অক্রিকেটীয় সবকিছুকে ‘ফালতু’ বলে উড়িয়ে দেওয়া এবং একের পর এক সিরিয়াস রসাত্মক ঘটনার জন্ম দেওয়াই ছিলো নাদির শাহর ব্র্যান্ড।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের পুরো উত্থানপর্বের স্বাক্ষী নাদির শাহ। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহর ছোট ভাই। সব ক জন ভাই চুটিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। তার মধ্যে নাদির শাহই খেলোয়াড় হিসেবে কম আলোচিত ছিলেন। তারপরও আবাহনী, মোহামেডান, বিমানের মত দলের হয়ে খেলেছেন। খেলোয়াড়ী জীবনেও একইরকম শুদ্ধাচারী ক্রিকেট ভক্ত ছিলেন।
পাকিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ বলতে পাগল ছিলেন।
নাদির শাহ শেষ বয়সে কাঠালবাগানের অধিনায়ক ছিলেন। এক ম্যাচে টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন। পরিষ্কার ভেজা উইকেট। আগে ব্যাট করলেই সর্বনাশ। নাদির শাহ তারপরও ব্যাটিং নিলেন এবং দল ২৬ রানে অলআউট হলো। কাঠালবাগানের কর্মকর্তারা ধরলো নাদির শাহকে-ব্যাপারটা কী?
নাদির শাহ বললেন, দ্রুত ফিরতে হবে। কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা আছে!
দিস ইস নাদির শাহ।
তার আম্পায়ারিং জীবন নিয়ে হাজারটা গল্প। তাঁর জন্য যে কত ম্যাচ বাংলাদেশে দেরি করে শুরু হয়েছে। কারণ, নাদির শাহ পৌছাতে পারেননি সময়ে। আর পৌছাতে না পারার কারণও বড় অদ্ভুত ছিলো।
একবার ফতুল্লায় খেলা। গুলিস্তান থেকে এসি বাসে উঠে নাদির শাহ কন্ট্রাক্টরকে বললেন, ‘লিসেন, কল মি হোয়েন ফাটুয়ালা স্টেডিয়াম কাম।’
কন্ট্রাক্টর তার এই চিবিয়ে বলা ইংরেজির কিচ্ছু বুঝলো না। শুধু স্টেডিয়াম শব্দটা বুঝলো আর বুঝলো, বড় সাহেব হবেন নিশ্চয়ই। ফলে পথে আর একবারও নাদির শাহকে বিরক্ত করলো না কেউ। নারায়নগঞ্জ জেলা স্টেডিয়ামের কাছে নিয়ে নাদির শাহকে নামিয়ে দেওয়া হলো। নাদির শাহ হতভম্ব হয়ে খোজেন, ‘হয়ার ইজ ফাটুয়ালা?’
এই হচ্ছেন নাদির শাহ।
শেষ জীবনে কিছু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেও নিজের সারল্য আর এই কথার জটিলতায়। নিশ্চিত করে বলা যায়, ক্রিকেটকে কলুষিত করার কোনো ইচ্ছে এই মানুষটির কখনো ছিলো না। কারণ, নাদির শাহর কাছে ক্রিকেটই তো জীবন।
আরেকটা গল্প আছে।
নাদির শাহ, জালাল আহমেদ চৌধুরীসহ অনেকে বেড়াতে গেছেন পলাশীর নীলকুঠি দেখতে। সেখানে গিয়ে ব্রিটিশদের অত্যাচার, লর্ড ক্লাইভের অন্যায় সম্পর্কে জেনে খুব চটে গেছেন নাদির শাহ। বেরিয়ে এসে জালাল আহমেদ চৌধুরীকে বললেন, ‘জালাল ভাই, দ্যাট ব্লাডি ক্লাইভ লয়েড ডেস্ট্রয়েড আস।’
জালাল ভাই অবাক হয়ে বললেন, ‘বাবু, ক্লাইভ লয়েড কী করেছে?’
নাদির শাহ বললেন, ‘ক্লাইভ তো। লয়েড হোক, আর লর্ড।’
এই হলেন নাদির শাহ। যার ইতিহাস পঠনও ক্রিকেটময়। যার সবকিছুই ক্রিকেট।
কিন্তু এটা কেমন হলো, নাদির ভাই। এভাবে চলে যাওয়ার তো কথা ছিলো না। এভাবে সব শূন্য করে কেনো রওনা দিলেন। এটা তো ক্রিকেট নয়।