বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে সব থেকে প্রতিভাবান আমি মোহাম্মদ আশরাফুলকে মনে করি। আজ যদি আশরাফুল এই বোলিং লাইন আপ পেতেন তাহলে হয়তো তামিম, মোমিনুল, মুশফিকুর আর সাকিবকে নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাছাকাছি ব্যাটিং লাইনআপ তৈরি করে ফেলতেন। হয় তো সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। কিন্তু, এই লেখাটা আশরাফুলকে নিয়ে নয়। এই লেখাটা বাংলাদেশের এই ক্ষুদ্র ক্রিকেট ইতিহাসে যদি বিশ্বমানের কেউ একজন এসে থাকেন তাঁকে নিয়ে। সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের অলটাইম গ্রেটেস্ট। এখনও পর্যন্ত।
ব্যাটার হিসাবে হয়তো আশরাফুল, মুশফিকুর, মুমিনুল, তামিম, সাকিবকে ছাড়িয়ে যাবেন। কিন্তু সার্বিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে সাকিবের সমকক্ষ সমসাময়িকদের মধ্যে বিশ্বক্রিকেটেই হয়তো লেট ব্লুমার জাদেজা ছাড়া কেউ নেই। তাও জাদেজা চার বা পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেননি।
কিন্তু জাদেজার সঙ্গে তুলনা নয়, সাকিবকে নিয়ে লিখছি। হয়তো বাংলাদেশের নিরিখে সময়ের আগে জন্মে যাওয়া ক্রিকেটার বলেই বোধহয়, খামখেয়ালিপনা চূড়ান্ত দেখিয়েছেন। অধিনায়কত্ব করতে গিয়ে দলকে এক রাখার অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু কেউ সাহসিকতার অভাবের দায় দোষী করতে পারবে না সাকিবকে।
আর বোলার সাকিব। বাংলাদেশে আমগাছ নাড়লেই বাঁহাতি স্পিনার পড়ে। মহম্মদ রফিক থেকে শুরু করে এমানুল হক, আব্দুর রজ্জাক, তাইজুল। সবাইকে মাথায় রেখেও সাকিব বোধহয় সেরাই। কেন? মহম্মদ রফিক ছাড়া সকলেই মডার্ন বাঁ-হাতি অর্থোডক্স স্পিনারের স্টাইলে ‘ডার্ট বোলার’। অর্থাৎ মাথা সোজা রেখে হাতটা কানের পাশ দিয়ে নিয়ে এসে গুডলেন্থের আশেপাশে বলটা ফেলবেন, পিচ শুকনো বা আঠা আঠা থাকলে বল হোল্ড করে স্পিন নেবে, না হলে উইদ দ্য আর্ম ভিতরে ঢুকবে।
কিন্তু সাকিব সেটা নন। আসলে আমি অনতিদূরের ইতিহাস যদি দেখি, তাহলে ড্যানিয়েল ভেট্টোরির কথা মনে আসে। সমসাময়িকদের মধ্যে মিশেল স্যান্তনার। তবে ভিত্তোরি ক্লাসিকাল বাঁহাতি স্পিনার, লুপ আর ফ্লাইট দুটোই ছিল। কিন্তু যে হেতু ভেট্টোরি বা স্যান্তনার উভয়েই শুকনো স্পিনিং উইকেটের সাহায্য পাননি তাই উভয়েরই অস্ত্র, ট্র্যাজেক্টরির হেরফের, বল ছাড়ার সময়ে হাতের অবস্থানের হেরফের এবং বলের গতির হেরফের।
সাকিবকে এখানেই এই দুজনের সঙ্গে একজায়গায় রাখতে চাই। সাকিবের উচ্চতা কিউইদের মতো নয়। কিন্তু উপমহাদেশের তুলনায় ঠিকঠাকই। অ্যাকশন যদি দেখেন তাহলে আরেক বঙ্গভাষী উৎপল চ্যাটার্জির কথা মনে পড়ে যাবে।
কিন্তু সাকিবের বোলিং-এর মজাটা হল ডান হাতের রাডারটা যখন তুলছেন এবং বাঁহাতটা নিয়ে আসবেন তখনও হেড পজিশন স্থির এবং সোজা থাকে, দুই চোখে ব্যাটারকে দেখেন। ফলস্বরূপ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলের লেন্থ, লাইন এবং গতির পরিবর্তন করতে পারেন। এই কারণেই অন্য কেউ টিকতে না পারলেও সাকিব কিন্তু বিদেশেও উইকেট পেয়েছেন। আর সীমিত ওভারে সাকিব একদম বিশ্বমানের বোলার। কারণ ওঁকে মেরে রান করা শক্ত। সেটা চেষ্টা করলে বুদ্ধির কাছে পরাস্ত হবার সম্ভাবনা।
ব্যাটার হিসাবে বরং বলব ইরফান পাঠানের একটু বেটার ভার্শন। বল ব্যাটে নিয়ে তারপর নিচের হাতের জোরে শট নেওয়া। মানে আপনি সাকিবকে একটা দৃষ্টিনন্দন, টাইমিং সর্বস্ব স্কোয়ার ড্রাইভ মারতে দেখবেন না, অথবা সামান্য উঠে আসা বলকে মিড উইকেট দিয়ে বাঁহাতিদের ব্রেড অ্যান্ড বাটারে কব্জির মোচড়ে বাইরে ফেলা। সাকিব গ্লান্স বা ফ্লিক মারবেন, কিন্তু সেটা আগে বলকে ব্যাটের মাঝখানে নিয়ে, সাবলীলভাবে নয়। আর এইখানেই সাকিবের বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ। সাড়ে চার হাজারের উপর রান তাও চার কিংবা পাঁচ নম্বরে ব্যাট করে। সেটা মুখের কথা নয়।
ফিল্ডিং সবসময়ই বিশ্বমানের ছিল, সে ক্লোজ ইন ক্যাচিংই হোক বা গ্রাউন্ড ফিল্ডিং। আর বিশ্বমানের ক্রিকেটারের কথাটা এল যখন তখন তার প্রমাণ স্বরূপ কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগগুলিতে সাকিবের চাহিদা বা উপস্থিতির কথা তোলাই যায়।
তবুও এতো করেও বাংলাদেশে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হল না বা চেয়েও হয়তো পছন্দের মিরপুরে তাঁর শেষ টেস্ট পাবেন না। সেটা কতকটা মানুষের মধ্যে না থাকা, ক্রিকেটের মাঠের স্মার্টনেস মাঠের বাইরে নিয়ে না আসা অথবা লাইফস্টাইলের কারণেই হয়তো। মানুষের মধ্যে থাকার জন্যই বর্তমান বাংলাদেশে সাকিবের মতোই ধীকৃত মাশরাফিকে নিজেদের নেতা হিসাবে মেনে নিয়েছিল বাংলাদেশি ক্রিকেটপাগল জনতা। সে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্তর থেকে বহু আগেই পতিত হবার পড়েও। সাকিব মুশফিকুর বা মাহমুদউল্লাহর মতো ক্ষুরধার মস্তিষ্কেরও নন (অবশ্যই মাঠের বাইরে), যে একটা বিশেষ ইমেজ রেখে দেশের জনতার নয়নের মণি হয়ে থাকবেন।
সাকিব, নিজের পথে চলেছেন। সকলের থেকে আলাদা। সেটা ভুল বা ঠিক হতে পারে, কিন্তু সেটা সাকিবের একদম নিজস্ব। প্রচুর বিতর্ক প্রচুর ভুল সিদ্ধান্ত পেরিয়েও যেটা থেকে যায়, যা হয়তো সময়ও বলবে, সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের আপাতত সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার এবং প্রথম বিশ্বমানের ক্রিকেটার। বিশ্বক্রিকেটে যিনি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নাম হতে পেরেছিলেন। অবশ্য সময়ের কথা কেই বা জানে!
আজ যিনি দেশে ঢুকতে পাচ্ছেন না, কাল হয়তো তিনিই জাতীয় বীরের মর্যাদা পাবেন। তবে সাকিব তার জন্য লালায়িত নন বোধহয়। আর নাটক করাটাও ওঁর আসে না। তাই বিভূঁইতে লজ্জার হার এবং শেষ ইনিংএর শূন্যর মাধ্যমেই তাঁর বিদায় মুহূর্ত ধরা থাকল।
না না ভুল বললাম, বিরাট কোহলির মতো মডার্ণ ডে গ্রেট সাকিবের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজের ব্যাট স্বাক্ষর করে তুলে দিয়েছেন সাকিবের হাতে, সেটাই বোধহয় শেষ আঁচড় হিসাবে রয়ে যাবে। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের জন্য এক হৃদয়নিষ্ঠ স্বীকৃতি!