বাসিল ডি অলিভেইরা, একজন জনগুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার

কেপটাউনের সেই ছোট্ট গ্রাম থেকে লর্ডসের বুকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন নেয়া যাত্রার কণ্টকাকীর্ণ পথটা বারবার রক্তাক্ত করলেও তিনি থেমে যাননি।

সেবার অ্যাশেজের পঞ্চম টেস্টে ওভালে মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড। অ্যাশেজ অস্ট্রেলিয়ার ঘরেই যাচ্ছে আগেই নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় ইংল্যান্ডের জন্য শেষ টেস্টটা ছিল কেবলই সান্ত্বনার। তবে একজনের জন্য সেই টেস্টটা ছিল নিজেকে চেনানোর, ক্রিকেট ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেবার। তিনি বাসিল ডি অলিভেইরা, ক্রিকেট মাঠে যিনি বর্ণবাদ, জাত-পাতের ভেদাভেদ সবকিছু মিলিয়েছেন এক বিন্দুতে। 

ওভালের সেই শেষ টেস্টের আগে বাসিল ডি অলিভেইরার সুযোগ পাওয়া নিয়েও হয়েছিল নানা নাটকীয়তা। প্রথম টেস্টে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করা সত্ত্বেও বাদ পড়েছেন পরের টেস্ট থেকে। দলের অধিনায়ক কলিন কাউড্রে তাঁকে বাদ দেন অতিরিক্ত বোলার খেলানোর অজুহাতে। অবশ্য তাঁর অনুপস্থিতিতে সুযোগ পাওয়া ব্যারি নাইট ভালোই বল করেছিলেন। যদিও মাঠের চাইতে মাঠের বাইরের রাজনীতিই মূল প্রভাবক ছিল তাঁর বাদ পড়ার পেছনে। 

যাই হোক ওভালের সেই টেস্টে ফিরে আসি। টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন ইংরেজ কাপ্তান কলিন কাউড্রে। প্রথম দিনের শেষভাগে ব্যাট করতে এসে অলিভেইরা অপরাজিত থাকেন ২৪ রানে। দ্বিতীয় দিন শুরুতেই ক্রিকেট বিধাতা তাঁর ‘খেল’ দেখিয়ে শুরু করেন। ৩১ রানে থাকা অবস্থায় তাঁর সহজ ক্যাচ মিস করে বসেন অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা উইকেটকিপার ব্যারি জার্মান।

ভাগ্যবিধাতা যেন সেদিন অলিভেইরা রূপে মর্ত্যে নেমে এসেছিলেন, জাতপাতের বিভেদটা যে আর মানা যাচ্ছিল না। আরও তিনবার জীবন পেয়ে অলিভেইরা শেষ পর্যন্ত থামেন ১৫৮ রানে। অলিভেইরার প্রতিটি রান যেন ছিল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে চপেটাঘাত। অবশ্য সেখানেই শেষ নয়, অলিভেইরা জাদু দেখান বল হাতেও। 

শেষদিনে ৮৫ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেলা অজিরা প্রায় বেঁচেই গিয়েছিল বৃষ্টির বদৌলতে। মাঠে পানি টইটম্বুর, শোনা যায় খেলা হবে না ধরে নিয়ে ড্রেসিংরুমে উল্লাস করতে শুরু করে দিয়েছিল অজিরা। ঠিক সেই সময়ে অভূতপূর্ব এক কাজ করে বসেন ইংরেজ দলনেতা কাউড্রে, দর্শকদের অনুরোধ করেন মাঠের পানি সরাতে।

পরের দেড় ঘন্টায় সবাই লক্ষ করেছিল অবিস্মরণীয় এক দৃশ্য, মাঠকর্মীদের সাথে মাঠের পানি সরাতে নেমে পড়েছে দর্শকরা। কেউ রুমাল, কেউবা পরনের কাপড় দিয়েই সীমানাদড়ির বাইরে ফেলছিল পানি। ফলশ্রুতিতে পুনরায় শুরু হয় ম্যাচ। তবে উইকেটে গেঁড়ে বসেছিলেন জন ইনভ্যারিটি এবং ব্যারি জার্মান। জার্মা যেন প্রতিজ্ঞা করেই নেমেছিলেন ক্যাচ ছাড়ার প্রায়শ্চিত্ত তিনি করবেনই। ডেভিড ব্রাউন, জন স্নো, রে ইলিংওর্থ, ডেরেক আন্ডারউডরা কোনোভাবেই পারছিলেন না এই জুটি ভাঙতে।

উপায়ান্তর না পেয়ে অধিনায়ক বল তুলে দেন অলিভেইরার। সেদিন যেন অলিভেইরা ‘মাইডাস টাচ’ পেয়েছিলেন, যা-ই ছুঁয়ে দিচ্ছিলেন সাফল্য হয়ে ধরা দিচ্ছিল। দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলেই ধরা দিল সাফল্য, তাঁর স্লো মিডিয়াম পেস বলটা গুড লেংথে পিচ করে উইকেটরক্ষকের কাছে যাবার আগে চুমু দিয়ে গেল অফস্ট্যাম্পে।

ম্যাচের পরের গল্পটুকু অবশ্য নিজের মত করে লিখেছিলেন ডেরেক আন্ডারউড, অজিদের লেজের অংশটা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন একাই। ইংল্যান্ড পেয়েছিল অ্যাশেজ ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় এক জয়। যদিও ছাইদানিটা সেবার গিয়েছিলে সাত সাগর পাড়ি দিয়ে অজি মুলুকেই। তবে পাল্টে গিয়েছিল বাসিল ডি অলিভেইরার ক্যারিয়ার।

আরেকটু পেছনে ফিরে যাই। ১৯৩১ সালে আফ্রিকার কেপটাউনে জন্ম অলিভেইরার। যদিও তাঁর জন্মসাল নিয়ে রয়েছে নানা লুকোচুরির ইতিহাস। ১৯৬৪ সালে ওরচেস্টারশায়ারে যোগ দেবার সময় জানিয়েছিলেন তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালে। পরে অবশ্য দলে জায়গা নিশ্চিত করার পর তা পিছিয়ে দিয়েছিলেন তিন বছর। নিজের আত্নজীবনীতে অবশ্য এহেন কাজের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন অলিভেইরা। জানিয়েছিলেন জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতেই লুকোচুরির আশ্র‍য় নেয়া, ‘আমার বয়স যদি ৩৫ না হয়ে ৪০ হতো, তাহলে কখনোই হয়তো জাতীয় দলে ডাক পেতাম না।’

কেপটাউনে মিশ্র বর্ণের এক সমাজে বেড়ে ওঠা অলিভেইরার। তখনকার সময়ের আফ্রিকার পুরোটাই ছিল বর্ণবৈষম্যে জর্জরিত। ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটও ছাড় পায়নি বর্ণবাদের কড়াল গ্রাস থেকে, সাদাদের জন্য ছিল আলাদা টুর্নামেন্ট।

অন্যদিকে কালো, মালয় এবং ভারতীয়রা খেলতো বিশেষায়িত আলাদা টুর্নামেন্ট। অলিভেইরার বাবা নিজেও ছিলেন ক্রিকেটার। যদিও তিনি কখনোই চাননি তাঁর ছেলে ক্রিকেট খেলুক। তিনি চাইতেন না যে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় মাঝে যাপন করতে হয় তাঁকে, তাঁর ছিঁটেফোঁটা স্পর্শ করুক তাঁর সন্তানকে। কিন্তু ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডান। 

ছোট্ট অলিভেইরার সারা দিন কাটে ক্রিকেটের সাথেই। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিলে কেপটাউনের অলিগলিতে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলতেই তাঁর আনন্দ। ১৫ বছর বয়সে স্থানীয় ফার্মে কাজ নেয় বালক অলিভেইরা। কাজের সময়টুকু যেন কাটতেই চায় না, মন পড়ে থাকে খেলার মাঠেই। এক বছর বাদেই সুযোগ পেয়ে যান স্থানীয় দল সেন্ট অগাস্টিনে।

সেন্ট অগাস্টিনের অধিনায়ক কে ছিল, জানেন? – লুইস ডি অলিভেইরা। বাসিলের বাবা।

অবাক বিস্ময়ে লুইস তাকিয়ে থাকেন ছেলের ব্যাটিংয়ের দিকে। প্রতিটা বলকে কি অসাধারণ ভঙিমায়ই না সীমানাছাড়া করছে তাঁর ছেলে। প্রতিটা বলই খেলছে মারমুখী ভঙ্গিতে, রেহাই পাচ্ছে না ভাল বলও। বাবার অধীনে নিজেকে শাণিত করেন তরুণ অলিভেইরা। রানবন্যা বইয়ে দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন রীতিমতো কিংবদন্তি হিসেবে।

তাঁর রানের কয়েকটি উদাহরণ দিই। এক ম্যাচে ২৮ ছক্কা আর ১০টি চারের সাহায্যে খেলেন ২৩৬ রানের অসাধারণ এক ইনিংস, যেখানে দলের বাকিদের অবদান ছিল সাকুল্যে নয় রান। অন্য এক ম্যাচে মাত্র ৮ বলে নিয়েছিলেন ৪৬ রান! ক্লাব পর্যায়ে নয় বছরে ৮২ বার সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি। 

‘ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে- এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ – মানিক বন্দোপাধ্যায়ের এই লাইনের মতো অলিভেইরার এই ব্যাটিংয়ের খবর পৌঁছোয় না বর্হিবিশ্বে। তিনি কিংবদন্তি হিসেবে অধিশ্বর হন, কিন্তু শুধুই কালোদের মাঝে। সুযোগ মেলে না রাজ্য দলে। প্রত্যক্ষ করেন পদে পদে অবহেলা, অপমানের গ্লানি।

কালোদের জন্য বিশেষায়িত এই লিগগুলোর কোনো স্বাকৃতি ছিল না, প্রথম শ্রেণির ম্যাচের স্বকৃতই ছিল কেবলই শ্বেতাঙ্গ লিগগুলোর। ১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে অলিভেইরার নেতৃত্বে কেনিয়া সফরে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা কৃষ্ণাঙ্গ দল। একই বছরে নন ইউরোপীয় কৃষ্ণাঙ্গ দলের হয়ে পূর্ব আফ্রিকা সফরে যান তিনি। সেই সফরের প্রথমবারের মতো বর্হিবিশ্বের নজর কাড়েন তিনি।

প্রতিটি ম্যাচেই রান করেন বিস্ফোরক গতিতে, তাঁর রানগুলো ছিল অনেকটা এমন – ১৩৯, ৫৬, ৪৮, ৯৬, ৩ এবং ৫০। এছাড়া বল হাতেও ছিলেন সমান উজ্জ্বল, স্লো মিডিয়াম পেসে তুলে নেন ২৫ উইকেট। নাইরোবিতে তাঁর ১৩৯ রানের ইনিংস দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন ইংল্যান্ড কিংবদন্তি ওয়ালি হ্যামন্ড।

দুই বছর পরই বিশাল সুযোগের দ্বার উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল অলিভেইরার জন্য। সেবার স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেলের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের কথা ছিল। সেই সফরে দক্ষিণ আফ্রিকা কৃষ্ণাঙ্গ দলের সাথে ম্যাচ খেলার সূচি ছিল তাঁদের। অলিভেইরা ধরে নিয়েছিলেন সেই সফরটা তাঁর ক্যারিয়ারের সুযোগ বিশ্ববাসীকে তাঁর প্রতিভা জানান দেয়ার, নিজেকে সেই মতো প্রস্তুতও করছিলেন। 

কিন্তু, শেষ মূহুর্তে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ভেস্তে যায় সেই সফর। হতাশা, ক্লান্তি, পরাজয়ের গ্লানিতে ভেঙে পড়েন অলিভেইরা। বুঝতে পারেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে তাঁর খেলার স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। তোড়জোড় শুরু করেন দেশত্যাগের। চিঠি লিখেন ব্রিটিশ সাংবাদিক জন আরলর্টকে। 

বর্ণবৈষম্যে আজীবন ধিক্কার পাওয়া অলিভেইরা তাই সবুজ কালিতে লিখলেন আরলর্টকে। জানালেন নিজের আকুল আকুতি। পৃথিবী আমূল বদলে দেবার বাসনা নেই, নেই সমান অধিকারের দাবি। তাঁর অনুরোধ কেবল একটুখানি ক্রিকেট খেলার সুযোগের। তাঁর শটে বাহবা দেবে দর্শক, স্টেডিয়ামে বাবার হাত ধরে আসা ছোট্ট শিশুটা স্বপ্ন দেখবে অলিভেইরা হওয়ার। বল হাতে উইকেট নিলে সতীর্থরা জড়িয়ে ধরবে- এটুকুই কেবল চাওয়া তাঁর। খুব কি বেশি চেয়ে ফেলেছিলেন অলিভেইরা?

তাঁর চিঠি চিন্তার আলোড়ন তোলে জন আরলর্টের। তিনি যোগাযোগ করেন ম্যানচেস্টারের প্রভাবশালী সাংবাদিক জন কে’র সাথে, যারা জানাশোনা ছিল ক্রিকেট দলগুলোর সাথে। ল্যাংকারশায়ার লিগের দল মিডলটনও এরকম কাউকে খুঁজছিলো, ক্যারিবীয় পেসার ওয়েস হল শেষ মূহুর্তে বেঁকে বসায় কিছুটা বেকায়দাতেই ছিলেন তাঁরা।

দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেলে মাসিক ৪৫০ পাউন্ড চুক্তিতে স্বদেশের মায়া কাটিয়ে ইংল্যান্ডের প্লেনে চড়ে বসেন অলিভেইরা। প্লেনের টিকিট কাটা নিয়েও পড়েন অকূলপাথারে। দারিদ্র‍্যের কষাঘাতে বড় হওয়া অলিভেইরা অত টাকা পাবেন কোথায়। অবশেষে বেনি বান্সডা নামের এক ভারতীয় সাংবাদিক অনুদান সংগ্রহ করে ২০০ পাউন্ড দিয়ে তাঁর প্লেনের টিকিট কেটে দেন।  শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়ের।

ইংল্যান্ডে আসার পর জীবন পুরো ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যায় অলিভেইরার। মিডলটনের সতীর্থরা তাকে বরণ করে নেন মহা আড়ম্বরে। স্থানীয় লোকজনও তাঁকে আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করেন। প্রথমবারের মতো পৃথিবীটাকে এত সুন্দর লাগে অলিভেইরার। সাদা মানুষরাও এতো ভালো হয়! ক্রিকেট মাঠে এবার সমস্ত কিছুর প্রতিদান দেবার পালা। নিজের সমস্তটা তিনি ঢেলে দেন বাইশ গজে। সময়ের সাথে সাথে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের তালিকায় নামটা উপরে উঠতে শুরু করে তাঁর। টুর্নামেন্ট শেষে দেখা যায় সবাইকে ছাপিয়ে চূড়ায় জ্বলজ্বল করছে একটি নাম – অলিভেইরা, বাসিল ডি অলিভেইরা। 

১৯৬২ সালে পূর্ব আফ্রিকা সফরের জন্য ঘোষিত আন্তর্জাতিক দলে ডাক পান তিনি। সেই দলে তাঁর সতীর্থ ছিলেন কলিন ম্যাকডোনাল্ড, রয় মার্শাল, সাইদ আহমেদ, স্যার এভারটন উইকস, সনি রামাধিন, সুভাষ গুপ্তের মতো ক্রিকেটাররা। নাইরোবিতে এক ঘন্টারও কম সময়ে সাত ছক্কায় সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি।

স্যার এভারটন উইকস এই ইনিংসকে আখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবে। সেই ম্যাচে বল হাতেও তিন উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। পরের বছর পিটার রিচার্ডসন, সিমুর নার্স, বাসিল বুচার, রোহান কানহাইদের সাথে কমওয়েলথ দলের হয়ে পাকিস্তান সফরে যান। উপমহাদেশের বোলিং নির্ভর ধীরগতির পিচেও রান করেন সমান গতিতে। সেই সিরিজে ৫২ গড়ে ২৬০ রান করে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ রানসংগ্রহকারী। সেই সফরেই টম গ্রাভিনির সাথে বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়ে অলিভেইরার। পরবর্তী জীবনে টমের হাত ধরেই এগিয়েছেন বহুদূর। 

ল্যাংকারশায়ার লিগের সফলতার পর টমের সাহায্যেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সুযোগ পান অলিভেইরা। মূলত টমের জোরাজুরিতেই তাঁকে দলে ভেড়াতে রাজি হয় ওরচেস্টারশায়ার। প্রথম বছরেই দুই বন্ধুতে মিলে দলকে জেতান কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপ। সেবছর টম আর অলিভেইরাই ছিলেন একমাত্র ব্যাটসম্যান যারা কিনা মৌসুমে দেড়হাজার রানের কোটা পূর্ণ করেছিলেন।

ততদিনে পেয়ে গিয়েছেন ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব। ফলশ্রুতিতে জাতীয় দলে ডাক পেতেও খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। শুধুমাত্র গায়ের বর্ণের কারণে যাকে আস্তা-কুঁড়েতে নিক্ষেপ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, আর তাঁরই কিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হলো ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে। কেপটাউনের সেই ছোট্ট শিশুর স্বপ্নটা সেদিন পূরণ হয়েছিল। প্রথম ইনিংসে ২৭ রানে রান আউট হলেও নিজের জাত চিনিয়েছেন পরের ইনিংসগুলোতে। ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ, গ্যারি সোবার্স,ল্যান্সি গিবসের মতো বোলারদের সামলে খেলেছিলেন যথাক্রমে ৭৬, ৫৪, ৮৮ রানের ইনিংস।

হেডিংলির সেই ৮৮ তো আজও ঘুরেফিরে আসে ক্রিকেট রোমান্টিকদের আড্ডায়, ৪৯ রানে চার উইকেট পড়ার পর ক্রিজে এসে রীতিমতো ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন ক্যারিবীয় বোলারদের উপর। তিন অংকের দেখা মেলে পরের সিরিজেই, ভারতের বিপক্ষে। প্রথম নয় টেস্টে রান করেছিলেন ৫২ গড়ে, পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ১২ উইকেট।

এরপরই সেই ওভাল টেস্ট কীর্তি। সেই সিরিজের পর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার কথা ছিল ইংল্যান্ডের। ওভাল টেস্ট যেদিন শেষ হয়, সেদিন রাতেই দল আফ্রিকা সফরের দল নির্বাচন নিয়ে বসেছিলেন নির্বাচকরা। তাঁদের উপর আগে থেকেই চাপ ছিল অলিভেইরাকে বাদ দেবার। আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট স্বয়ং ভোরস্টার মাসছয়েক আগেই এমসিসির প্রেসিডেন্ট লর্ড কোবহ্যামকে জানিয়ে দিয়েছিলেন বাসিল ডি অলিভেইরাকে যেন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে না আনা হয়।

আফ্রিকার মাটিতে ব্যাট হাতে রাজত্ব করবে কালো বর্ণের এক সন্তান, এ যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না আফ্রিকার শাসকগোষ্ঠী। পরদিন ছিল ক্রিকেটের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক দিন। এমসিসির সদস্যরা একে একে সবগুলো নাম পড়ে গেলেও তাতে ছিল না অলিভেইরার নাম। দল ঘোষণার পরই পুরো দেশ, গণমাধ্যম বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমনকি অলিভেইরা কে ছাড়া দল বহনকারী বিমানকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার হুমকি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন এক ক্রিকেটপ্রেমী। এরপর গল্পে আসে নাটকীয় এক মোড়।

দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিল ডি অলিভেইরা’র সাথে রকিবুল হাসান ও শহীদ জুয়েল (বামে)।

টম কার্টরাইট দল থেকে সরিয়ে নেন নিজের নাম। হাতে থাকা অন্য ক্রিকেটাররাও অস্বীকৃতি  জানান দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যেতে। ফলে অলিভেইরাকে দলে ডেকে নেয়া ছাড়া অন্য কোনো অপশন ছিল না এমসিসির হাতে। তাছাড়া ততদিনে আশেপাশের সমালোচনায় আরেকটু শক্ত হয়েছে এমসিসি। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে হুমকি ধামকি আসতেই কড়া ভাষায় চিঠি লিখে জানিয়ে দেয়া হলো অলিভেইরাকে ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাচ্ছে না ইংল্যান্ড।  চাইলে তাঁরা সিরিজ বাতিল করতে পারে।

বোঝা যাচ্ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে আর খুব বেশি বাকি নেই। অবশেষে ২৪ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়ে দেয় এ সফর হচ্ছে না। ভোরস্টার জিতেছিলেন তার জাতপাতের লড়াইয়ে। অলিভেইরাকে খেলতে দেননি দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে। তাতে আদতে ক্ষতি হয়েছে আফ্রিকার, নিজেদের সেরা সন্তানকে তো হারিয়েছেই প্রতিপক্ষের কাছে। ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত থাকতে হয়েছে ২৪ বছর। 

ওই কান্ডের পর আরও চার বছর চুটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন অলিভেইরা। পরের সিরিজেই ঢাকার মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেন অপরাজিত ১১৪ রানের দারুণ এক ইনিংস। ১৯৭০ সালে অবশ্য এমসিসি চেষ্টা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে ইংল্যান্ডে আনবার।

কিন্তু, সে চেষ্টা সফল না হলেও বিশ্ব একাদশের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটাররা আসেন ইংল্যান্ড সফরে। প্রথমবারের মত আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের সামনে ক্রিকেট মাঠে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পান অলিভেইরা। বিশ্ব একাদশের সেই দলে গ্যারি সোবার্সের নেতৃত্বে এসেছিলেন ব্যারি রিচার্ডস, এডি বারলো, গ্রায়েম এবং পিটার পোলক, মাইক প্রোক্টরের মতো ক্রিকেটাররা।

প্রথম টেস্টে লর্ডসে সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগিয়েও ৭৮ রান করে আউট হন অলিভেইরা। তবে এজবাস্টনে আর তাঁকে থামানো যায়নি, খেলেন ১১০ এবং ৮১ রানের দারুণ দুই ইনিংস। পিটার পোলকের এক বাউন্সারে হুক করে বলকে পাঠিয়েছিলেন স্টেডিয়ামে বাইরে। নিরীহদর্শন মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে তুলে  নিয়েছিলেন রোহান কানহাই, ক্লাইভ লয়েড, মাইক প্রক্টরদের মতো ব্যাটারের উইকেট। 

ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার অখ্যাত ক্রিকেট লিগে। রানের পর রান করেও পাননি স্বীকৃতি। ক্যারিয়ারের গোধূলি-বেলায় দেখিয়ে গিয়েছেন তাঁর সামর্থ্য। বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁকে অবহেলায় আদতে ক্ষতিটা হয়েছে ক্রিকেটেরই। ৪১ বছর বয়সে ব্যাটজোড়া তুলে রাখার আগে ৪০.০৬ গড়ে পাঁচ শতক আর পনেরো অর্ধশতকে করেছেন ২৪৮৪ রান। ওভালেই সেই ১৫৭৮ উজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংস হয়ে। বল হাতেও ছিলেন সমান সাবলীল, সেট হয়ে যাওয়া জুটি ভাঙতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ৩৯.৫৫ গড়ে নিয়েছেন ৪৭ উইকেট। 

পরিসংখ্যান দিয়ে আসলে বাসিক ডি অলিভেইরাকে মাপতে যাওয়া বৃথা। ক্রিকেট মাঠের রাজনীতি, বর্ণবাদ, বৈষম্য সবকিছু ছাপিয়ে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর যাত্রাটার জন্য। কেপটাউনের সেই ছোট্ট গ্রাম থেকে লর্ডসের বুকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন নেয়া যাত্রার কণ্টকাকীর্ণ পথটা বারবার রক্তাক্ত করলেও তিনি থেমে যাননি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...