ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের প্রতিক্রিয়াটা শুধু রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা লিভারপুল ফ্যান নয়, পুরো বিশ্বের যতজন দর্শক তাকিয়ে ছিলেন টিভি পর্দায় তাদের সকলেরই প্রতিক্রিয়া ছিল।
চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালের ২৭ তম মিনিট চলছে। অ্যালিসন তখনও মাটিতে লুটিয়ে আছেন। প্রথম গোলের ৩০ সেকেন্ড পার হয়েছে কী হয়নি, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র এসে দাড়ালেন টনি ক্রুসের সামনে। মাথা নত করে সম্মান জানালেন গোলের ক্রিয়েটরকে। যেন রাজার সামনে প্রজা নিজের সর্বোচ্চ সম্মানে মাথা নত করা। টনি ক্রুসও সেই সম্মান মেনে নিলেন মাথা পেতে।
টনি ক্রুসের অনন্য এক পারফরম্যান্সের একটা ছোট্ট উদাহরণ ছিল এই লং পাস। মিলিতাওয়ের কাছ থেকে হালকাচালে পাওয়া একটা পাস। সেখান থেকে সাকমান্য একটুখানি হাতের ইশারা, ডান পায়ের হালকা একটু সুইং; বাকি কাজটা যেন রিয়াল মাদ্রিদের ট্রেনিং গ্রাউন্ড ভালবেদেসই করে নিলো। স্পেনের আধার নেমে আসা আকাশে ধুমকেতুর মতন উড়ে চলা বল ঠিক খুঁজে নিল ভিনিসিয়ুসের বুক। বাকি ছিল শুধু ভিনিসিস্যুসের ঠাণ্ডা মাথায় ফিনিশ করা। রিয়ালের জার্সিতে এটুকু করতেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন বড্ড। কিন্তু এতো সুন্দর পাস ব্যর্থ হতে দেখলে হয়তো বিধাতা নিজেও আফসোস করতেন।
পাক্কা ৬০ গজ। নিজেদের ডি-বক্সের সামান্য বাইরে থেকে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের মাথায়। একেবারে পিন পয়েন্ট লং পাস যাকে বলে, সেটাই করে দেখিয়েছেন টনি ক্রুস। আউটফিল্ড প্লেয়ার হিসেবে সবচেয়ে বেশি লং বল এসেছে তার পা থেকেই। লিভারপুলের মিডফিল্ড ট্রিও মিলে যেখানে পুরো ম্যাচে লং বল বানিয়েছে দুইটি, সেখানে ক্রুস একাই দিয়েছেন ৫ টি!
জিদানের উপর কম প্রেশার ছিল না ম্যাচের আগে। এমনিতে নিয়মিত অধিনায়ক সার্জিও রামোস চোট নিয়ে মাঠের বাইরে। সঙ্গী রাইট ব্যাক কার্ভাহালও। মার্সেলোকে দলে রাখা মানে তো ডিফেন্স উৎসর্গ করা। আর ম্যাচের ৬ ঘন্টা আগে কোভিড পজিটিভ হয়ে সরে গিয়েছেন ভারানে। আগেরদিন সকলে যখন ভাবছিল জিদান হাঁটবেন থ্রি-ম্যান ডিফেন্সের পথে, সেখানে সব হারিয়ে জিদান ফিরে গিয়েছেন নিজের বিশ্বস্ত ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। আর পুরো দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন ‘জার্মান স্নাইপার’ টনি ক্রুসের উপরে।
‘বল পাও তো ক্রুসকে দাও, বাকিটা সেই সামলে নিবে’ – গতকাল ভালবেদেসে জিদানের ট্যাক্টিস ছিল এটাই। এবং ক্রুস ডেলিভারও করেছেন বটে। যুদ্ধের ময়দানে স্নাইপারের কাজ যেমন থাকে পেছন থেকে কাভার দেওয়া, ঠিক সেটাই করেছেন টনি ক্রুস।
দ্বিতীয় গোলের বেলাতেও, বাম পাশ দিয়ে বারবার বল নিয়ে যাওয়ার জায়গা খুঁজছিলেন মেন্ডি-মদ্রিচ-ভিনিসিয়ুস। ব্যর্থ হয়ে ব্যাক পাস করতে করতে বল এসে থামল ক্রুসের পায়ে। টনি ক্রুস দেখলেন, সামান্য একটু হাত উঁচু করলেন। যেন রোবটের কমান্ড কিংবা টয় স্টোরির অ্যান্ডির আগমনের মতন। মানুষ আসলেই সকলে বুঝে যায়, এখন আর নড়াচড়া করা চলবে না। ক্রুসের ব্যপারটাও তাই, এক সেকেন্ড চোখ বুলালেন মাঠের উপর, পিন পয়েন্ট লং পাস মেন্ডি বরাবর। কাবাক, আর্নল্ডের মাথার উপর দিয়ে বল খুঁজে পেল মেন্ডির পা। বেশি কিছু করতে হয়নি তাকে, শুধু বলের ডিরেকশন ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন অ্যাসেন্সিও বরাবর। ফলাফল ম্যাচের ৩৬ মিনিটের মাথাতেই ২-০ গোলে এগিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ।
পুরো ম্যাচে ক্রুসের ৭৪ পাসের মধ্যে ৬৪টি খুঁজে পেয়েছি ঠিক নিশানা। শতকরার হিসেবে ৯০.৪ ভাগ পাসিং একুরেসি তার। ম্যাচের মধ্যে হায়েস্ট। নিজেদের অর্ধ থেকে লিভারপুলের অর্ধে দিয়েছেন ৪৪ড়ি, এর মিধ্যে ক্লিয়ার কাট গোল স্কোরিং চান্স ক্রিয়েট হয়েছে ৪ টিতে। পুরো ম্যাচে তার অর্ধেক চান্স ক্রিয়েট করতে পারেননি কেউ।
ঠিক কোন জায়গাটাতে সফল হয়েছেন ক্রুস? জিদানের বিশ্বাসের জায়গাতে। এই লিভারপুল দুই বছর আগের লিভারপুল নেই। এই রিয়ালও সেই রিয়াল নেই। কিন্তু মিডফিল্ডটা আছে। চোটজর্জর লিভারপুলের ডিফেন্সের স্তম্ভ ভার্জিল ভ্যান ডাইক নেই। ফলে অ্যারিয়াল ডিফেন্ডিংয়ে উইক লিভারপুলের ডিফেন্সের সামনে ক্রুসকে দাঁড় করিয়ে দিয়তেছেন জিনেদিন জিদান। ক্রুসও তার প্রতিদান দিয়েছেন দুই হাত ভরে।
ক্রুসের দুটো পাস, দেখে কোনোভাবেই মনে হবে না কঠিন কিছু। ম্যাচের তৃতীয় এসিস্টটা দেখুন, বেনজেমার কাছ থেকে বল পেয়ে মদ্রিচ যে পাসটা দিয়েছেন ভিনিসিয়ুস বরাবর, দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। কিন্তু ক্রুসের বেলায়? ক্রুসের কোনো পাস দেখে আপনার কখনও মনেই হবে না এটা কোনো চোখ ধাঁধানো পাস। কিংবা ম্যাচ ডিফাইনিং কিছু।
ক্রুসের ম্যাজিকটা ঠিক সেখানেই, সবচেয়ে দূর্দান্ত প্লে মেকিংও তিনি সকলের চোখে বোরিং করে দেন। তাও তো তার থ্রি-পিটের সঙ্গী মদ্রিচ নাম পেয়েছেন ‘ক্রোয়েট ম্যাজিশিয়ান’, ক্যাসেমিরো পেয়েছেন ‘ব্রাজিলিয়ান ট্যাঙ্ক’। সেখানে ক্রুস হয়ে আছেন ‘জার্মান স্নাইপার’। আড়াল থেমে ক্যামোফ্লেজ হয়ে খেলা চালানোটাই যার লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্যে সফলও!