বর্তমানে ক্রিকেটে ভাগ্যবান এবং দুর্ভাগা শব্দদুটি প্রায়শই শোনা যায়। বিশেষ করে পাকিস্থানের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে শব্দদুটো যেন একটু বেশিই ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি ফাওয়াদ আলমদের ফর্ম কিংবা নওমান আলি-তাবিশ খানের বেশি বয়সে সুযোগ পাওয়া প্রশ্ন তোলে পাকিস্থান কি বড্ড বেশি দেরি করে ফেললো কি না। মনে করিয়ে দেয় পূর্বের হতভাগ্যদের কথা, যাদের মাঝে সম্ভাবনা ছিল পুরো বিশ্বক্রিকেটকে নেতৃত্ব দেবার। অনেকেই আছেন যারা কিনা নিজেদের প্রতিভা পূর্ণ বিকশিত করার সুযোগ পাননি।
জালালউদ্দিন, একদিনের ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিককারী বোলার। অথচ তিন বছরে মাত্র ছয় টেস্টেই শেষ হয়ে গেছে তার ক্যারিয়ার। তার সতীর্থ ওয়াজাহতুল্লাহ ওয়াস্তির ক্যারিয়ারও বিনষ্ট হয়ে গেছে অঙ্কুরেই। অথচ প্রথম ছয় টেস্টেই দুই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ঝলমলে এক ক্যারিয়ারের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই তাকে দল থেকে বাদ দেয়া হয়।
অনিল দলপত খেলতে পেরেছিলেন নাত্র নয়টি টেস্ট। হাসান রাজার মতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র সাতটি ম্যাচে। অথচ তার মাঝে প্রতিভার স্বাক্ষর পেয়ে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটানো হয়। বাজিদ খান তো আরো দুর্ভাগা, তার অভিষেক টেস্ট হয়ে আছে ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ টেস্ট হয়ে। তবে এই তালিকার সবচেয়ে দুর্ভাগা বোধহয় আসিম কামাল।
১২ টেস্টের ক্যারিয়ারে আটবারের বেশি পেরিয়েছেন পঞ্চাশ রানের কোটা। তার ক্রিজে ঘন্টার পর ঘন্টা টিকে থাকার মানসিকতা ছিল বিস্ময়কর। অথচ তাকে আর পরে সুযোগ দেয়া হয়নি। ফয়সাল ইকবাল এবং ইয়াসির হামিদ দুজনের শুরুটাই ছিল আশাজাগানিয়া কিন্তু কেউই ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। ইয়াসির হামিদ তো ক্যারিয়ারের অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেছিলেন।
অথচ, তাঁদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে যথাক্রমে ২৬ এবং ২৫ টেস্ট খেলেই। দানিশ কানেরিয়া হতে পারতেন আব্দুল কাদির ও মুশতাক মোহাম্মদের যোগ্য উত্তরসূরি। কিন্তু পাকিস্থান ক্রিকেট বোর্ডের ঘৃণ্য রাজনীতির কারণে হারিয়ে গেছেন ফুল হয়ে ফুটবার আগেই।
এতটুকু পড়েই খারাপ লাগছে সুযোগ না পাওয়াদের জন্য, তবে আসুন দেখে নেয়া যাক আরো তিনজনকে যারা কিনা বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশে জন্মালে হয়তো হতেন ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা। সিকান্দার বখত, পাকিস্থানের হয়ে টেস্ট ক্যাপ পাওয়া ৭৪ নম্বর ক্রিকেটার। লম্বা এবং ফিট সিকান্দার গতিশীল না হলেও বড় বড় স্পেলে একটানা ভালো জায়গায় বল করে যাবার বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন।
ইমরান খান-সরফরাজ আহমেদের পাশে তৃতীয় পেসার হিসেবে তিনি ছিলেন একদম পারফেক্ট। মুশতাক মোহাম্মদের অধীনে ১৯৭৬ সালে অভিষেক হলেও সিকান্দারের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় ১৯৭০-৮০ মৌসুমে ভারত সফরের মাধ্যমে। অধিনায়ক আসিফ ইকবালের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে সে সফরের দলে ছিলেন না সরফরাজ আহমেদ। অন্যদিকে সফরের শুরুতেই ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে যান ইমরান খানও। ফলে সেবার বোলিং লাইনআপের পূর্ণ নেতৃত্ব ছিল সিকান্দারের হাতে।
সেই সুযোগ তিনি কি দারুণভাবেই না কাজে লাগান, সেই সিরিজে ২৪ উইকেট নেন তিনি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে পরের সিরিজের প্রথম টেস্টের দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত সিকান্দার হতবাক হয়ে যান নির্বাচকদের সিদ্ধান্তে। এরপর আর কখনোই নিজের হারানো ফর্ম ফিরে পাননি তিনি। অথচ সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। আরেকজন হতভাগ্য ক্রিকেটার হলেন শোয়েব মোহাম্মদ, পাকিস্থানের ৯৭ নম্বর ক্যাপধারী টেস্ট ক্রিকেটার।
পাকিস্থান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সংকীর্ণ মানসিকরা কতটা বাজে হতে পারে তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ শোয়েব মোহাম্মদের ক্যারিয়ার। এমনিতেই কিংবদন্তী বাবা-চাচাদের কারণে চাপের মাঝে খেলতে হয়েছে তাকে। তাকে নিয়মিতই দলে ডাকা হতো আবার কোনো কারণ ছাড়াই দল থেকে বাদ দেয়া হতো। বাদ দেয়ার কারণগুলোও ছিল হাস্যকর।
কখনো বলা হতো শোয়েব অনেক ধীরে খেলছেন আবার কখনো বলা হতো তিনি বড্ড বেশি আক্রমণাত্মক। নিজের খেলা ৪৫ টেস্টে শোয়েব মোহাম্মদ রান করেছেন ৪৪.৩৪ গড়ে, ওপেনার হিসেবে বিশ্বের যেকোনো দলে খেলার জন্য যা যথেষ্টই। অন্যদিকে তার বদলে যাকে খেলানো হয় সেই রমিজ রাজা ৫৭ টেস্টে রান করেছেন মাত্র ৩১.৮৩ গড়ে।
ক্যারিয়ারে বারবার যাওয়া-আসার মাঝে শোয়েবের সেঞ্চুরি সাতটি সেখানে নিয়মিত খেলে যাওয়া রাজার শতক মাত্র দুইটি। রমিজ রাজা যেখানে পেয়েছেন অফুরন্ত সুযোগ, সেখানে তাঁর ভাই ‘দ্য মাস্টার ব্লাস্টার’ ওয়াসিম হাসান রাজাকে বিবেচনা করা হয় পাকিস্থানের সবচেয়ে হতভাগা ক্রিকেটার হিসেবে।
সত্তরের দশকের শেষভাগে বিশ্বকাঁপানো দুধর্ষ সেই ক্যারিবিয়ান পেস বোলিং লাইন আপকে যিনি সামলেছেন হেলমেট ছাড়াই। কেবল ক্যাপ পড়ে মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টসদের সীমানছাড়া করেছেন অসীম মুগ্ধতায়। প্রায় ৫৮গড়ে পাঁচটি পঞ্চাশোর্ধ ইনিংসে সেবার করেন ৫১৭ রান। পাশাপাশি তার লেগস্পিনও ছিল যথেষ্ট সাড়াজাগানিয়া। পোর্ট অফ স্পেনে তার লেগস্পিনের ভেলকিতেই ম্যাচ জিতেছিল পাকিস্তান।
সেদিন অ্যান্ডি রবার্টস এবং ডেরেক মারের ব্যাটিংয়ে ম্যাচ প্রায় বাঁচিয়ে ফেলেছিল ক্যারিবিয়রা। কিন্তু রাজা চার ওভারের মাঝে তিন উইকেট নিয়ে দলকে এনে দেন দারুণ এক জয়। ১৯৭৯-৮০ মৌসুমে ভারত সফরেও পাকিস্থানের সেরা তারকা ছিলেন রাজা। প্রথমবার ১৯৭৯-৮০ সফরে ছয় টেস্টে রান করেন ৫৬.২৫ গড়ে। বছর তিনেক পরের সিরিজে আরো ভয়ংকর রাজা, এবার রান করেন ৬০ ছাড়ানো গড়ে। বিশেষ করে পাঞ্জাবে তিনি খেলেছিলেন অসাধারণ এক ইনিংস।
শেষ দুই উইকেটে যোগ করেছিলেন ৭৩ রান। এরমাঝে মাত্র চার করেছিলেন দুই বোলার মোহাম্মদ নাজির এবং আজিম হাফিজ। পাশাপাশি সেই টেস্টে বল হাতেও নিয়েছিলেন চার উইকেট। কিন্তু শিক্ষিত এবং ঠোঁটকাটা রাজা কখনোই বোর্ডের প্রিয়পাত্র হতে পারেননি। বিশেষ করে বোর্ডের অনেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন না রাজার ব্যাপারে। তার ভদ্র ব্যবহার এবং শিক্ষিত ব্যাকগ্রাউন্ড থাকার কারণে তিনি সবসময় অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
পাকিস্থান ক্রিকেট কখনোই এ ধরনের চরিত্রের সাথে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনি এবং এজন্যই তাকে কখনো দলে নিয়মিতে হতে দেয়া হয়নি। এই ব্যর্থতা রাজাকে বানিয়েছিল পাকিস্থান ক্রিকেটের সবচেয়ে নষ্ট প্রতিভাতে। রাজার মাঝে যে পরিমাণ প্রতিভা এবং সম্ভাবনা ছিল তাতে তার পাকিস্থানের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটারদের মাঝে স্থান পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো পাকিস্থানের তরুণ প্রজন্ম তার ব্যাপারে কমই জানে। কি লজ্জার!
– দ্য ডন অবলম্বনে