২২ তম ওভারের চতুর্থ বল – অফস্ট্যাম্পে পরে সামান্য ভেতরে এসে আছড়ে পড়লো প্যাডে। আগে ব্যাট ছুঁয়েছে ভেবে ফিল্ডিং দলের আবেদনে সাড়া দিলেননা আম্পায়ার
২২ তম ওভারের পঞ্চম বল – আবার ও পড়লো অফস্ট্যাম্প লাইনে। এবার সফলভাবে পুশ করে স্কোয়ারে বল রাখলেন ব্যাটসম্যান।
২২ তম ওভারের ষষ্ঠ বল – আবার ও একই লেংথ কিন্তু এবার ঘটনা ঘটলো একটু আলাদা। মিডল স্ট্যাম্পে পরে নিচু হয়ে যাওয়ার পরে যখন ব্যাটসম্যান বিট হয়েছেন তাঁর কিছুক্ষণ বাদে তিনি দেখলেন বলটি এসে নড়িয়ে দিয়েছে তার অফ স্ট্যাম্প।
এখন বলটি যে সামান্য নিচু হয়েছে এর কিছুটা কৃতিত্ব যদি ১৯৯৯ ভারত-পাকিস্তান সিরিজের প্রথম টেস্টের চেন্নাই মাঠের চতুর্থ ইনিংসের পিচের হয় তাহলেও কিন্তু ব্যাটসম্যানকে দুর্দান্তভাবে সেটআপ করার কৃতিত্ব দিতে হবে লাহোর নিবাসী চৌধুরী মোহাম্মদ আকরামের সন্তানকে। অবশ্য এ কাজ তার নতুন নয়, আগেও করেছেন অনেক তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যানদের ঘোল খাওয়ানোর কাজ এবং এখানেও আবার করলেন। ওহ, ব্যাটসম্যানের নাম বলতে ভুলে গেছি না? রাহুল শরদ দ্রাবিড়।
একদা দিলীপ ভেঙ্গসরকার কলকাতার এক স্কুলে এসে বলেন ‘ওয়াসিম আকরাম তো শুধু ব্যাটসম্যানদের বিপদে ফেলত তা নয়, ডিপ্রেশনে পাঠিয়ে দিত।’ পরে আরো বলেন, ‘ভাই তখনও তুমি স্বমহিমায় পৌঁছনি। তবুও এক ওভারে চারটে ইনসুইং ইয়র্কার দিয়েছিলে। মারাত্মক বাড়াবাড়ি নয়?’ আদতে সেই ওভারটির জন্য মাত্র তিন রান ব্যতিরেকে আটকে যায় দিলীপ ভেঙসরকারের সেঞ্চুরি।
এখন স্বমহিমায় পৌঁছানোর পরে একটা লোক কি করতে পারে তা দেখার জন্য স্ট্যাট খুলেছিলাম এবং অভিভূত হয়ে দেখছিলাম সেই কীর্তি। নব্বইয়ের দশকে টেস্টে আক্রাম রেখেছেন ২১ গড় এবং ৪৮ স্ট্রাইক রেট যা সমকালীন অন্যরা অর্থাৎ কোর্টনি ওয়ালশ (২০ গড়, ৫২ স্ট্রাইক রেট), কার্টলি আম্ব্রোস (২৫ গড়, ৫৯ স্ট্রাইক রেট), গ্লেন ম্যাকগ্রা (২২ গড়, ৫২ স্ট্রাইক রেট), অ্যালান ডোনাল্ড (২১ গড় এবং ৪৫ স্ট্রাইক রেট) এদের সবার থেকে এগিয়ে।
এই হিসেবে শুধু ওয়াকার ইউনুস (২১ গড়, ৪০ স্ট্রাইক রেট) এগিয়ে থাকবেন তার থেকে, নাহলে সম্পূর্ণ দশ বছরের নিরিখে তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা পেসার! আবার ওয়ানডে খেলায় আকরাম ২৩ গড় এবং ৩৬.৬ স্ট্রাইক রেটের সঙ্গে রাখেন ৩.৮৩ ইকোনমি। এখানে তিনি শুধুমাত্র শন পোলকের সঙ্গে একাসনে অধিষ্টিত(৩.৮৩ ইকোনমি)। উল্টোদিকে বড়ো ওয়ানডে বোলার বলতে ওয়াকার ইউনুস (৪.৬১), অ্যালান ডোনাল্ড (৪.০৪), জাভাগাল শ্রীনাথ (৪.১০) ব্রাকেটে দেওয়া সংখ্যায় খরচ করে গেছেন।
এখন আকরামকে সবার থেকে এগিয়ে রাখার একমাত্র কারণ যেখানে ওয়ালশ-আম্ব্রোস ফাস্ট বোলিং সহযোগী ক্যারাবিয়ান পিচ পেয়েছেন, ম্যাকগ্রা-ডোনাল্ড পেয়েছেন বাউন্সভরা পিচ সেখানে ওয়াসিম আক্রাম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপমহাদেশে খেলেছেন যেখানে ট্রাক চালানোর পক্ষে আদর্শ উইকেট বা স্পিন বোলিং সহায়ক উইকেট বেশি এবং গ্রিনটপ ততটাই কম যতটা কলকাতার শশব্যস্ত রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি। ও এশিয়াতে কিন্তু কোনো ফরম্যাটেই গড় ২৫ ছাড়ায়নি।
আচ্ছা সাফল্যের রহস্য কোথায় নিহিত? কিভাবে তিনি পেরেছেন প্রায় ১৭ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাজ করতে? আকরাম ব্যাখ্যা করেন নিজেই। তিনি একবার মুনাফ প্যাটেলের শর্ট রানআপে মিডিয়াম পেস করা সম্মন্ধে বলেন, ‘ও যদি মনে করে মুনাফ প্যাটেল হয়ে থাকবো তবে তো এটাই ঠিক আছে। কিন্তু যদি বলে মুনাফ থাকতে চাইনা, ইতিহাস হতে চাই তাহলে সপাটে মনে করাবেন এটুকু করে ইতিহাস হওয়া যায় না। তাহলে ফাঁকিবাজিতে চলবেনা। ইতিহাস হতে চাইলে জ্বলন্ত আগুনের সঙ্গে অবিরাম সংঘর্ষ করে যেতে হবে।’
সেই অবিরাম সংঘর্ষের জোরেই কি কপিল দেবের কাছে ভালো ব্যাটসম্যানের যোগ্যতা আকরামকে মানা হয়? শেন ওয়ার্ন এতো ফাস্ট বোলার থাকতেও আকরামকে সর্বোচ্চ রেট করেন? বিশ্বকাপ ফাইনালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট ইমরানের হাতে তুলে দেয় বহুকাঙ্খিত বিশ্বকাপ?
ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতাকে সারা জীবন লালন করতে যে শক্তি লাগে তা তো দেয় মনের জোর এবং যে কোনো প্রতিকূলতায় অবিচলিত থাকার ক্ষমতা এবং তাই দিয়েই তো করা যায় জ্বলন্ত আগুনের সঙ্গে অবিরাম সংঘর্ষ। আজ প্রতিভা, মনের জোর সব কিছু মিলিয়েই উন্নীত তিনি।