নেদারল্যান্ডস আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম দুটি ম্যাচে জিতে রীতিমতো উড়ছিল পাকিস্তান। কিন্তু আহমেদাবাদে ভারতের বিপক্ষে খেলতে নেমেই বদলে গেল দৃশ্যপট। সেই যে প্রথম হারের তিক্ত স্বাদ নিল তাঁরা, এরপর পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বেরই হতে পারছে না বাবর আজমের দল। এক নয়, দুই নয়, তিনও নয়, হারের হ্যাটট্রিককে ছাপিয়ে টানা ৪ ম্যাচ পরাজয়ের স্বাক্ষী হলো পাকিস্তান। যার সর্বশেষটা এলো দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে রোমাঞ্চ জাগানো ম্যাচে ১ উইকেটের হারে।
উপমহাদেশের কন্ডিশনে বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ শুরুর আগে তাই বড় এক স্বপ্ন নিয়েই ভারতে পা রেখেছিল পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা। তবে এখন পর্যন্ত ৬ ম্যাচের মধ্যে পাকিস্তানের দলগত যা পারফরম্যান্স, তাতে নিজেদের ক্রিকেট অহমই টিকিয়ে রাখাটা দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যে দুটি দলের বিপক্ষে পাকিস্তান জয় পেয়েছে, সেই দুই দল নবম ও দশম দল হিসেবে এবারের বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল। তাই নেদারল্যান্ডস আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় পাওয়াটা পাকিস্তানের জন্য মোটেই সফলতার কোনো গল্প নয়। তাছাড়া, এর পাশাপাশি আফগানিস্তানের বিপক্ষে পাকিস্তান যেন পাত্তাই পায়নি। ৮ উইকেটের সেই হারই মূলত পাকিস্তানকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানের এমন বেহাল দশার কারণ কী? পাকিস্তানি অনেক সাবেকদের মতেই, এর প্রথম দায় অধিনায়ক বাবরের। ব্যাটিংয়ে বাবর বিশ্বসেরাদের কাতারে একজন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ব্যাটারের নেতৃত্ব নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট নন ওয়াসিম আমরাম, শোয়েব আখতার, শোয়েব মালিকের মতো সাবেক অধিনায়করা।
পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটারদের এমন অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। বরং তাদের এমন অসন্তুষ্টির যথার্থ কারণ রয়েছে। একাদশ নির্বাচন থেকে শুরু কর ম্যাচের কৌশল নির্ধারণসহ অনেক বিষয়েই বাবর বিচক্ষণতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয়, ম্যাচে বোলিং চেঞ্জ, ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা, ষষ্ঠ বোলারের ব্যবহার, আউট অব দ্য বক্স চিন্তা- বাবরের নেতৃত্বে এমন কোনো কিছুরই ছাপ পাওয়া যায়নি। শরীরী ভাষাতেও বাবরের মাঝে তেমন আত্মবিশ্বাসের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অধিনায়ক ছাড়াও পাকিস্তানের এমন ধারাবাহিক ব্যর্থতার পিছনে আছে দৃষ্টিকটু ফিল্ডিং। আফগানিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া দুই ম্যাচেই তিন থেকে চারটি করে ক্যাচ ফেলেছে পাকিস্তান। অবশ্য ফিল্ডারদের এমন ব্যর্থতার পিছনে উঠে এসেছে ফিটনেস ইস্যুও। বর্তমান দলটির লম্বা সময় ধরে কোনো ফিটনেস টেস্ট নেয়া হয় না। যার প্রভাব পড়ছে পারফরম্যান্সেও।
আর এটি নিয়ে তো ক্রিকেটারদের এক প্রকার ধুয়েই দিয়েছেন ওয়াসিম আকরাম। পাকিস্তানি ফিল্ডারদের ফিটনেস অবস্থা কত বাজে তা বুঝাতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘ওদের ফিটনেস দেখুন। দেখে মনে হচ্ছে, তারা প্রতিদিন আট কেজি করে গোশত খায়।’
এ ছাড়া আরো কয়েকটা কারণ উল্লেখ করতেই হয়। যে পেসত্রয়ী নিয়ে পাকিস্তান বিগত বছরগুলোতে প্রতিপক্ষের উপর ত্রাস ছড়িয়েছে, সেই তিন পেসারের মধ্যে ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপে নেই নাসিম শাহ। যার অনুপস্থিতি বেশ ভুগিয়েছে পাকিস্তানকে।
এর পাশাপাশি, বিশ্বকাপ চলাকালীন ক্রিকেটারদের জ্বরে আক্রান্ত হওয়াকে অনেকেই ছন্দ হারানোর কারণ বলে মনে করেন। তবে শাদাব খান অবশ্য দলের ব্যর্থতার পিছনের সেটির দায় দিতে নারাজ।
এশিয়া কাপ থেকেই ছন্দে নেই স্পিনাররা। শাদাব খান কিংবা মোহাম্মদ নওয়াজ, কেউই প্রতিপক্ষের জন্য ভীতিকর হতে পারেননি। এমনকি উইকেট শিকারের দিক দিয়ে পাকিস্তানের এই স্পিন ইউনিট ছিল তলানির দিকে। এমন দুর্বল স্পিন আক্রমণও এবারের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বেহাল দশার কারণ।
তবে সবচাইতে বড় কারণ বোধহয়, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের মধ্যে চলমান অস্থিতিশীলতা। মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো বদল হয়েছে বোর্ড প্রধান আর কোচিং স্টাফ। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর কোচিং স্টাফ থেকে ছেটে ফেলা হয় সাকলায়েন মোশতাক ও মোহাম্মদ ইউসুফকে। অথচ, সেবার ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল পাকিস্তান।
৬ ম্যাচে ৪ হার। কার্যত পাকিস্তানের সেমির রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে এখানেই। খাতা কলমে অনেক যদি কিন্তুর উপর ঝুলে আছে সেই রাস্তা। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে শেষের রোমাঞ্চ পরাজয়ের ক্ষণই শুধু দীর্ঘায়িত করেছে। তবে আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত হার এড়াতে পারেনি। আর তাতে পাকিস্তানের এ হার-যাত্রা আপাতত অব্যাহতই থাকছে।