সংবাদে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ বিচিত্র একটা খবরে চোখ আটকে গেলো-ভারতের জুনিয়র টেনিস দল এখন পাকিস্তান সফরে আছে।
খবরটা এমনিতেই কৌতুহল উদ্দীপক।
ভারতীয় এই কিশোরদের জন্য পাকিস্তান ম্যানেজমেন্ট নিরামিষ খাবারের ব্যবস্থা করছে। তাদের দেখভালের নানা ব্যবস্থা করেছে। ভারতীয় কতৃপক্ষও খুব খুশি পাকিস্তান ম্যানেজমেন্টের আতিথেয়তায়।
এসব পড়তে পড়তেই মনে হলো, ভারত-পাকিস্তানের না সীমান্তে সমস্যা চলছে! ভারত-পাকিস্তানের না সবধরণের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন? ২০০৬ সালের পর থেকে ভারতীয় ক্রিকেট দল আর কখনো পাকিস্তান সফর করেনি। ২০০৭ সালের পর আর দুই দল কখনোই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলেনি। তাহলে টেনিস দল পাকিস্তান সফরে গেল কী করে?
শুধু টেনিস দল নয়। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, ভারতীয় হকি দল, জিমন্যাস্ট দল মাঝে মাঝেই পাকিস্তান সফরে যায়। পাকিস্তানী বিভিন্ন খেলার খেলোয়াড়রাও ভারত সফরে আসেন। তার মানে পরিষ্কার যে, দুই দেশের সীমান্তের সম্পর্ক অন্য কোনো খেলায় সেভাবে প্রভাব ফেলছে না। কেবল ক্রিকেটেই যত সমস্যা।
ক্রিকেটে সমস্যা এতো তীব্র যে, ভারতে অনেক বন্ধু থাকার পরও নতুন পিসিবি চেয়ারম্যান রমিজ রাজা বলেছেন, তিনি সম্প্রতি ভারতের সাথে সিরিজের কোনো সম্ভাবনা দেখেন না।
কিন্তু কেন? সব বাদ দিয়ে পাকিস্তানের ক্রিকেটেই কেন সমস্যা ভারতের? নাকি ক্রিকেটারদের চেয়ে টেনিস দলের খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা কম জরুরি? পাকিস্তান যদি ক্রিকেটের জন্য অনিরাপদ হয় – তাহলে তো সব রকম খেলাধুলার জন্যই অনিরাপদ হওয়া উচিৎ।
এই প্রশ্নের উত্তর পরিস্কার করে আমাদেরও জানা নেই। তবে আমরা জানি, ক্রিকেট দুনিয়া জুড়ে এরকম কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ কারবার চলছে। জর্জ ডোরবেল তার ক্রিকইনফো কলামে যে কাজ কর্মকে বলেছেন – হিপোক্রেসি ও ডাবল স্টান্ডার্ড।
এই ডাবল স্টান্ডার্ড আমরা নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রেও দেখলাম।
কোনো একটা হুমকি পাওয়ার কথা বলে খেলা শুরুর দিন নিউজিল্যান্ড সফর বাতিল করে পাকিস্তান থেকে চলে গেলো। সেই হুমকিটা কী, সেটা তারা না প্রকাশ্যে, না গোপনে কাউকে পরিষ্কার করেছে। হুমকিটা আদৌ সত্যি সত্যি বড় কোনো ব্যাপার ছিলো কি না, সেটা পরিষ্কার হওয়া যায়নি। কিন্তু তারা বিস্ময়করভাবে কাউকে কিছু না বলে পাকিস্তান থেকে খেলোয়াড়দের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।
দাবিটা সোজা, পাকিস্তান তাদের কাছে অনিরাপদ।
অথচ ক্রাইস্টচার্চে অমন ভয়াবহ হামালার পরও কোনো দেশ নিউজিল্যান্ডকে একটা দিনের জন্যও অনিরাপদ বলেনি। বাংলাদেশ দল সেই হামলার শিকার হতে বসেছিলো। তারপরও বাংলাদেশ আবার সেই নিউজিল্যান্ডে সফর করেছে। বিশ্বের কোনো দল নিউজিল্যান্ড সফরের সময় প্রেসিডেন্সিয়াল নিরাপত্তা দাবি করেনি এরপরও।
আর এটাই হলো ডাবল স্টান্ডার্ড।
এর চেয়েও বিষ্ময়কর কাজ করলো ইংল্যান্ড। তারা নিউজিল্যান্ডের দেখাদেখি তাদের পরিকল্পিত সফর বাতিল করে দিলো। মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানে ইংল্যান্ডের হাই কমিশন পরিষ্কার করে বলেছে, তারা ইসিবিকে এই সফর বাতিল করার পরামর্শ দেয়নি। এমনকি পাকিস্তান সফর করতে বাড়তি সতর্কতার কোনো নির্দেশনাও কতৃপক্ষ জারি করেনি। এই ক’দিন আগেই ইংল্যান্ডের ‘ডিউক অ্যান্ড ডাচেস অব ক্যাম্ব্রিজ’ পাকিস্তান সফর করে এসেছেন। নিরাপত্তাকে তাদের সফরের ক্ষেত্রে সমস্যা মনে হয়নি। অথচ ইসিবি কী এক হাওয়ায় ভেসে পাকিস্তান সফর বাতিল করে দিলো।
জর্জ ডোরবেল এর সাথে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ শুরুর খানিক আগেই লন্ডন ব্রজে এক লোক ইচ্ছাকৃতভাবে ভিড়ে গাড়ি তুলে দিয়ে মানুষ মেরেছিলো। সে সময় কিন্তু খেলা চালিয়ে যেতে কোনো সমস্যা হয়নি।
আসলে এমন উদাহরণ আমরা ইতিহাস ঘাটলে অনেক পাবো।
মুম্বাই হামলার পরও ভারত অনিরাপদ হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে একটা হোটেলের সামনে পটকা ফোটায় পুরো দেশকে অনিরাপদ ভেবে সফর বাতিল করেছিলো কয়েকটা দেশ। এমন কিছু কাজ কর্ম চলছেই। এসব কাজের সমালোচনা খোদ ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ভারতেও হচ্ছে।
বারবার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে যে, সমস্যাটা আসলে কোথায়?
আমরা বলছি না যে, পাকিস্তান সফর করতেই হবে। পাকিস্তান তুলনামূলক অনিরাপদ জায়গা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই পাকিস্তানে অন্য সব সম্পর্ক জিইয়ে রেখে কেবল ক্রিকেট সফরই কেনো বারবার বাতিল হয়, এটুকু প্রশ্ন তো তোলা যেতেই পারে।
অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান উসমান খাজা সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমি মনে করি পাকিস্তানকে না বলাটা খেলোয়াড় ও সংস্থার জন্য খুব সোজা, কারণ এটা পাকিস্তান। এটা যদি বাংলাদেশ হতো, তাহলেও একই রকম ব্যাপার ঘটতো। কিন্তু একই পরিস্থিতিতে কেউ ভারতকে না বলতে পারতো না। টাকা কথা বলে, আমরা সবাই জানি। সম্ভবত এক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রেখেছে এটি। তারা একের পর এক টুর্নামেন্ট আয়োজন করে প্রমাণ করছে যে ক্রিকেট খেলার জন্য পাকিস্তান নিরাপদ। সেখানে আমাদের না যাওয়ার কোনো কারণ দেখি না।’
মোদ্দা কথা হচ্ছে – অনেক দলই বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ইস্যুতে একেক দলের সাথে একেক রকম আচরণ করে। নিরাপত্তা জনিত কারণে অস্ট্রেলিয়া কয়েক দফা বাংলাদেশ সফর পিছিয়েছে। বাংলাদেশ সফরে এসেও মাঝপথে সিরিজ বাতিল করে দেশে ফিরেছে অনূর্ধ্ব ১৯ দল। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও অনূর্ধ্ব ১৯ দলকে পাঠায়নি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। ক্ষতিগ্রস্ত এখানেও দিন শেষে ক্রিকেটই হয়।