২০০০ সালের ২৬ জুন দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে মর্যাদা পাবার মাস পাঁচেক পরই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নভেম্বরের ১০ তারিখ টেস্ট অভিষেক হয় বাংলাদেশের। প্রথম টেস্টকে কেন্দ্র করে আজ থেকে দুই দশক আগে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারি পরিণত হয়েছিল এক বিশাল জনসমুদ্রে। সেখানে উপস্থিত সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল উৎসবের আমেজ। নাইমুর রহমান দুর্জয়ের নেতৃত্বে এমন উৎসবমুখর পরিবেশে প্রথম টেস্ট খেলতে নামে বাংলাদেশ।
সেদিন যাঁদেরকে ঘিরে পুরো দেশের অগণিত ক্রিকেটভক্তের মধ্যে উৎসব-উন্মাদনা কাজ করেছিল সেই ১১ জন ক্রিকেটারের কেউই বর্তমানে বাইশ গজে নেই। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ খেলা ছেড়ে ক্রিকেট প্রশাসনের দায়িত্বে জড়িয়ে গেছেন কেউবা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। ভারতের বিপক্ষে দেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচে খেলা সেই ১১ জন বাংলাদেশি ক্রিকেটার এখন কোথায় আছেন, কী করছেন- চলুন জেনে নেয়া যাক এক এক করে।
- শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ
দেশের অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসে ১২ ও ৭ রান করা ওপেনিং ব্যাটসম্যান শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ বারবার জাতীয় দলে অবহেলিত হওয়ায় রাগ-ক্ষোভ নিয়ে ২০০৪ সালে খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানেন। খেলা ছাড়ার পর পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। বর্তমানে সেই ব্যবসাটাই চালিয়ে যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের এই ক্রিকেটার।
- মেহরাব হোসেন অপি
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে শাহরিয়ার হোসেনের সাথে ইনিংস ওপেন করা মেহরাব হোসেন অপি ব্যাট হাতে তাঁর পার্টনারের মতই ব্যর্থ ছিলেন। প্রথম ইনিংসে ২ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ রান করে টেস্ট অভিষেকটা একদমই স্মরণীয় করে রাখতে পারেননি তিনি। ২০০৩ সালে পাঁচ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানার পর পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন অপি। বর্তমানে বাংলাদেশ যুব দলের ব্যাটিং কোচ হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
- হাবিবুল বাশার সুমন
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম হাফ সেঞ্চুরি করা এই ব্যাটসম্যান দেশের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৭১ রান করার পাশাপাশি দ্বিতীয় ইনিংসে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩০ রান করেন। দীর্ঘদিন জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করা হাবিবুল ২০০৭ সালে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান। তবে ক্রিকেট খেলাকে বিদায় বললেও ক্রিকেট থেকে দূরে সরে থাকতে পারেননি তিনি। ২০১১ সালে প্রথমবারের মত জাতীয় ক্রিকেট দলের নির্বাচকের দায়িত্ব পান তিনি যা অদ্যাবধি সফলভাবে পালন করে যাচ্ছেন।
- আমিনুল ইসলাম বুলবল
অভিষেক টেস্টে ব্যাট হাতে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানের ঐতিহাসিক ইনিংসটি এখনো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি ইনিংস হিসেবে বিবেচিত। সেদিন ৫৩৫ মিনিট উইকেটে থেকে ৩৮০ বল মোকাবেলা করে ১৭টি চারের সাহায্যে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রানের এই ইনিংসটি তিনি খেলেন। এর ফলে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানের পাশাপাশি বিশ্বের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে নিজের ও দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন বুলবুল।
তবে ঐতিহাসিক ওই ম্যাচের পর আর বেশিদিন খেলা চালিয়ে যাননি তিনি। জাতীয় দলে অবহেলিত হতে থাকায় অনেকটা অভিমান থেকেই ২০০২ সালে ক্রিকেট থেকে সরে আসেন বুলবুল। খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেট কোচিংয়ের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। একসময় এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) ডেভলপমেন্ট অফিসারের দায়িত্বে থাকা বুলবুল চীনে ক্রিকেট ডেভলপিংয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলে (আইসিসি) ডেভলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
- আকরাম খান
বাংলাদেশের ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জেতা অধিনায়ক আকরাম খান অভিষেক টেস্টে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। প্রথম ইনিংসে ৩৫ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর ব্যাট থেকে আসে মাত্র ২ রান। ৮টি টেস্ট ও ৪৪টি ওয়ানডে খেলা আকরাম খান ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। তারপর তিনি ক্রিকেট প্রশাসনের কাজে যুক্ত হয়ে যান।
২০০৭ সালে প্রথমবারের মত জাতীয় দলের নির্বাচকের দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১১ সালে তিনি হয়ে যান প্রধান নির্বাচক। বছর যেতে না যেতেই ২০১২ সালে এ পদ থেকে সরে দাঁড়ান আকরাম। এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত টানা ৪ বছর বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেয়া এই সাবেক ব্যাটসম্যান।
- আল শাহরিয়ার রোকন
১৭ বছর আগে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে মিডল অর্ডারে খেলা ব্যাটসম্যান আল শাহরিয়ার রোকন এখন নিউজিল্যান্ড প্রবাসী। ওই টেস্টের দুই ইনিংসে ১২ ও ৬ রানের ইনিংস খেলে তিনি ছিলেন পুরোপুরি নিষ্প্রভ। ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর ২০০৮ সালে সপরিবারে নিউজিল্যান্ডে থিতু হন তিনি। পরে নিউজিল্যান্ডে তিনি হ্যাভলক নর্থ ক্লাবের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে মাঠ মাতান। ২০১৭ সালের শুরুতে সেখান থেকেও অবসরের সিদ্ধান্ত নেন রোকন। বর্তমানে হ্যাভলক নর্থ ক্লাবেরই কোচিংয়ে নিযুক্ত আছেন ঢাকার এই ক্রিকেটার।
- নাইমুর রহমান দুর্জয়
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে নিজের স্পিন ভেলকিতে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের নাকানি চুবানি খাওয়ানো নাইমুর রহমান দুর্জয় প্রথম ইনিংসে ৪৪.৩ ওভার বল করে ১৩২ রান খরচায় তুলে নেন ৬ উইকেট। ম্যাচে বল হাতে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেও ব্যাট হাতে তিনি ছিলেন পুরোপুরি ব্যর্থ। দুই ইনিংসে ব্যাট করে সংগ্রহ করেন কেবল ১৫ ও ৩ রান।
সাদা পোশাকে দেশের হয়ে মাত্র ৮টি টেস্ট খেলা দুর্জয় অবসরে যান ২০০২ সালে। ক্রিকেট থেকে অবসরে গেলেও এখনো ক্রিকেটের সাথে তিনি যুক্ত আছেন বিসিবির হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। তাছাড়া ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) এই সভাপতি মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছেন।
- খালেদ মাসুদ পাইলট
অভিষেক টেস্টে গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান ইতোমধ্যে কোচ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের (ডিপিএল) দল প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের বর্তমান কোচ খালেদ মাসুদ পাইলট ভারতের বিপক্ষে ওই ম্যাচে ৩২ ও অপরাজিত ২১ রানের ইনিংস খেলেন। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানো এই ব্যাটসম্যান ক্লেমন রাজশাহী ক্রিকেট একাডেমির পরিচালকের দায়িত্বও সামাল দিচ্ছেন এখন।
- মোহাম্মদ রফিক
বাংলাদেশ ক্রিকেটের কিংবদন্তি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক দেশের প্রথম টেস্টে বল হাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। প্রথম ইনিংসে তিনি তুলে নেন ৩টি উইকেট। ব্যাট হাতেও তিনি প্রথম ইনিংসের শেষ দিকে দলের পক্ষে ২২ রানের কার্যকরী একটি ইনিংস খেলেন। ২০০৮ সালে খেলা ছাড়ার পর এখন তিনি কোচিং পেশায় নিযুক্ত আছেন। সবশেষ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) রংপুর রেঞ্জার্সের স্পিন বোলিং কোচের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
- হাসিবুল হোসেন শান্ত
অভিষেক টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ২৫ ওভার বল করে মাত্র ১টি উইকেট পাওয়া পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত ক্রিকেট ছাড়ার পর ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। তবে বর্তমানে বাংলাদেশ যুব দলের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্বরত তিনি।
- বিকাশ রঞ্জন দাস (মাহমুদুল হাসান রানা)
ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টটাই ছিল বিকাশ রঞ্জন দাসের ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট। সে ম্যাচে তাঁর একমাত্র শিকার প্রথম ইনিংসে ৫৮ রান করা ভারতীয় ওপেনার সাদাগোপান রমেশ। ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট হিসেবে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে মাঠে নামা এই বাঁহাতি পেসার খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেট মাঠ থেকে একেবারে দূরে সরে যান। বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে তিনি চাকরিরত আছেন।