বাংলাদেশের সেটা ইতিহাসের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি।
২০০৭ বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতিমূলক টুর্নামেন্ট হচ্ছিলো নাইরোবিতে। পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা সেদিন। বোলিং লাইনআপে শোয়েব আখতার, মোহাম্মদ আসিফ। শোয়েবদের তোপে ১৯১ রানের জবাব দিতে নেমে বাংলাদেশ গুটিয়ে গেল ১৬১ রানে।
এই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাড়িয়েই বাংলাদেশের এক তরুণ ওপেনারের ব্যাটে উল্লাসের জয়গান। বিশ্ব অবাক হয়ে শুনলো পাকিস্তানের ওই ভয়াবহ বোলিংয়ের বিপক্ষে ৫০ বলে ৮১ রানের ইনিংস খেলেছেন তিনি। কে এই তরুণ?
মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিন।
বাংলাদেশের আরও অনেক অকালে হারিয়ে যাওয়া প্রতিভার মধ্যে নাজিমউদ্দিন একজন। চট্টগ্রাম থেকে আফতাব আহমেদ, তামিম ইকবালদের কাছাকাছি উঠে এসেছিলেন এই তরুন। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে অন্তত দারুন একটা শুরু করে বলেছিলেন, তিনি থাকতে এসেছিলেন। কিন্তু সেই নাজিমউদ্দিন এখন কোথায়?
চট্টগ্রামে এসেও নাজিমউদ্দিনকে খুজে পেতে একটু বেগ পেতে হলো। যেনো কোনো খবরেই নেই। কয়েক হাত বদলে শেষে তার ফোন নম্বর পাওয়া গেলো। পুরোনো পরিচিত লোক পেয়ে ম্লান হেসে বললেন, ‘এখন কোচিং করাচ্ছি। ঢাকায় খেলাঘরের কোচ হিসেবে আছি দু বছর। লেভেলে ওয়ান কোচিং কোর্স করেছি। এটাই আমার জীবন।’
এই জীবন কী হওয়ার কথা ছিলো, নাজিমউদ্দিন?
না, নাজিমউদ্দিন নিজেও জানেন, এমন জীবন হওয়ার কথা ছিলো না তার। এমন বিস্মৃত হয়ে পড়ার কথা ছিলো না। তারকার বেশে মানুষের চোখে চোখে থাকার কথা ছিলো। কিন্তু তা হয়নি।
নাজিমউদ্দিন ছিলেন প্রডিজি; বালক প্রতিভা।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার পারফরম্যান্স জাতীয় নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলেছিলো। চট্টগ্রামের হয়ে ওই ১৬ বছর বয়সে যেভাবে রান করেছিলেন, তাতে খুব দ্রুত তাকে অনুর্ধ্ব-১৯ এবং ‘এ’ দলে ডেকে ফেলা হলো। সেখানেও দারুন ধারাবাহিক নাজিমউদ্দিন।
২০০৫ জাতীয় লিগের ফাইনালে দুই ইনিংসে ১০৩ ও ৮২ রান করেও চট্টগ্রামের হার এড়াতে পারেননি। কিন্তু বার্তাটা দিতে পেরেছিলেন। তাকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিলো ‘এ’ দলের সাথে। সেখানেও ভালো করায় ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে ডাকা হয়।
বিশ্বকাপের প্রস্তুতি টুর্নামেন্টে পরপর দুই ম্যাচে ৪৩ ও ৮১ রান। তখন মনে হচ্ছিলোম, নাজিমউদ্দিন থাকতে এসেছেন। কিন্তু সব এলোমেলো করে দিলো এক আইসিএল। এর মধ্যে ওয়ানডে অভিষেক হয়েও গেলো। কিন্তু সেখানে ধারাবাহিক হতে পারছিলেন না। একটু সময় গেলে হয়তো চেনা রূপে দেখা যেতো। কিন্তু সেই সময়টা পাওয়ার আগেই আইসিএলে চললেন নাজিমউদ্দিন।
ভারতের বিদ্রোহী এই ক্রিকেট লিগে যোগ দিয়ে পেলেন ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা। পরে আইসিএল বিলুপ্ত হওয়ায় নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
নাজিমউদ্দিন এখন পেছন ফিরে দেখতে পান, আইসিএলে যাওয়াটা তার জন্য খুব ভুল একটা সিদ্ধান্ত ছিলো। বলছিলেন, ‘আইসিএলে না গেলে আমার ক্যারিয়ারটা হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। ঠিক হয়নি। আইসিএলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।’
নাজিমউদ্দিন আরও একবার আলোয় এসেছিলেন। ২০১১ সালে ডাক পেয়েছিলেন টেস্ট দলে।
প্রথম টেস্টেই পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই ইনিংসে ৩১ ও ৭৮ রানের দুই ইনিংস। এরপরও ৩ টেস্টের চেয়ে লম্বা হয়নি তার ক্যারিয়ার। তারপর আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছেন নাজিমউদ্দিন।
আজ পেছন ফিরে তিনি দেখেন শুধু আক্ষেপের এক খতিয়ান। একটু ভেবে বলেন, ‘আজকাল তো ব্যাটসম্যানরা অনেক সুযোগ পায়। আমি সেভাবে সুযোগ পেলাম না তো। শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও ৪২ রান করেছিলেন। তারপর আর ডাক পেলাম না। টেস্টে অমন শুরুর দুই টেস্ট পরই বাদ পড়লাম। আরেকটু সুযোগ হয়তো আশা করতে পারতাম।’
জাতীয় লিগে দারুন ফর্মে থাকা অবস্থায়ও তেমন সুযোগ পাননি। এখনকার ক্রিকেট দেখে একটু আফসোস হয়-আহ, এই সময়েও যদি থাকতাম!
আফসোস অবশ্য এখন নাজিমউদ্দিনের কাছে পুরোনো হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে শেষ ঢাকা লিগ খেলার ভেতর দিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন। খেলাঘরের হয়ে শেষ খেলেছেন। ওখানেই কোচিং শুরু করেছেন। সর্বশেষ ভারতে মাস্টার্স কাপে গিয়েছিলেন খেলতে। ৫ ম্যাচে একটি ফিফটিসহ ১৮০ রান করেছিলেন।
সেই আগের ধার তো নেই। তারপরও চার-ছয়গুলো যখন মারছিলেন, একটু আফসোস কী আমাদেরও হচ্ছিলো না? আমাদেরও কী মনে হচ্ছিলো না যে, এমন ব্যাটসম্যানকে আমরা পুরোটা পেলাম না!
না, নাজিমউদ্দিন আর খুব পেছনে ফিরে তাকাতে চান না। সামনে দেখতে চান। বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ দল এখন ভালো ক্রিকেট খেলছে। গত কিছুদিন হয়তো ভালো যাচ্ছে না। দ্রুতই আবার দেখবেন ভালো করবে। আমি দোয়া করি, দল যেনো সবসময় ভালো খেলে; এই ছেলেরা যেনো ভালো খেলে। আমি চাই আমাদের দলটা টেস্টে ৫ নম্বরের মধ্যে চলে আসুক। তাহলে আমিও সব দু:খ ভুলে যাবো।’
তাই হোক, নাজিমউদ্দিন। আপনি খেলোয়াড় তৈরি করুন। তাদের দেখে আমরাও দু:খটা ভুলি।